নভেম্বর ০৪, ২০২৩ ১৫:৫৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ড. মোস্তফা চামরানসহ ইরানি যোদ্ধা ও কমান্ডারদের সাহসিকতা ও বীরত্ব নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কমান্ডার শহীদ হোসেইন খাররাজির বীরোচিত অবদান নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

যেকোনো আলোচনায় ইরানের নাম উঠলেই তার সঙ্গে উঠে আসবে এদেশের ঐতিহাসিক শহর ইস্পাহানের নাম। এই শহরটিতে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন; বিশেষ করে নাকশে জাহান স্কয়ার এবং জয়ান্দে নদীর উপর স্থাপিত দু’টি সেতু পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। তবে ইস্পাহানের ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করা আজ আমাদের উদ্দেশ্য নয় বরং ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি ইস্পাহান যে সাহসী কিছু যোদ্ধাও জন্ম দিয়েছে আজ সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব।  ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরব্যাপী পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের যেসব প্রদেশে সবচেয়ে বেশি যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন সেগুলোর মধ্যে ইস্পাহান অন্যতম। অপরাধী সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইস্পাহানের বহু পরিবারের দুই থেকে তিন সদস্য শহীদ হয়েছেন। ইস্পাহানের সন্তান- এরকম একজন শহীদের নাম হোসেইন খাররাজি।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় হোসেইন খাররাজি ছিলেন ১৪ ইমাম হোসেইন (আ.) ব্রিগেডের কমান্ডার। ওই যুদ্ধে ইরানের প্রতিটি প্রদেশ থেকে বাসিজ বা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর আলাদা আলাদা ব্রিগেড অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রদেশগুলোর স্বেচ্ছাসেবীদের রিক্রুট করার দায়িত্ব থাকত সংশ্লিষ্ট ব্রিগেডের হাতে। যুদ্ধের শুরুতে মাত্র ২৪ বছর বয়সে এরকম একটি ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলেন হোসেইন খাররাজি। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তিনি একজন দক্ষ কমান্ডারে পরিণত হন এবং ইরানের একটি শক্তিশালী ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন।   হোসেইন খাররাজি ১৯৫৭ সালে ইস্পাহানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার পর সারাদেশে বিপ্লব বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা রুখতে তৈরি করা হয় গণবাহিনী। মাত্র ২২ বছর বয়সে হোসেইন খাররাজি ইস্পাহানে এরকম একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এর কিছুদিনের মধ্যে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুর্দিস্তান প্রদেশে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইরান থেকে কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ওই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে সারাদেশ থেকে গণবাহিনীর সদস্যদের তলব করা হয়। হোসেইন খাররাজি ওই আহ্বানে সাড়া দেন এবং কুর্দিস্তানে চলে যান। সেখানে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে প্রথমে পাভে শহর এবং পরে কুর্দিস্তানের কেন্দ্রীয় শহর সানান্দাজ মুক্ত করার অভিযানে অংশ নেন।

শহীদ খাররাজি তার অনন্যসাধারণ প্রতিভা দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে যুদ্ধের সমস্ত কলাকৌশল আয়ত্ব করেন। তাকে সানান্দাজ শহরে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির স্ট্রাইকিং ফোর্সের কমান্ডার করা হয়।  তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী কুর্দিস্তানের কয়েকটি শহর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করে সেসব শহরে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

পরবর্তীতে ইরাকি বাহিনী দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে ইরানে আগ্রাসন শুরু করলে আগ্রাসী বাহিনী তেমন কোনো সুসংগঠিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। কারণ, দেশ রক্ষা করার মতো সুশৃঙ্খল অবস্থা তখন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর ছিল না।  যৎসামান্য সামর্থ্য নিয়ে ইরান যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা আগ্রাসী বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না।  এ কারণে রণাঙ্গণ থেকে ইরাকি বাহিনীর হাতে একের পর এক ইরানি শহরের পতনের খবর আসতে থাকে। এ অবস্থায় শহীদ খাররাজি ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুর্দিস্তান অঞ্চলের দায়িত্ব হস্তান্তর করে দক্ষিণাঞ্চলে ছুটে যান। আইআরজিসির তৎকালীন কমান্ডার জেনারেল ইয়াহিয়া রহিম সাফাভি তাকে দারখুইন এলাকায় ইরাকি বাহিনীকে মোকাবিলা করার দায়িত্ব দেন।

হোসেইন খাররাজি দারখুইনের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপরই আহওয়াজ-আবাদান মহাসড়কসহ ওই এলাকার রণাঙ্গণে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি কারুন নদীর বাধ ভেঙে দিয়ে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে পানি প্রবেশ করান এবং এর ফলে শুকনো ভূমি রাতারাতি বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়। ফলে ওই এলাকা দিয়ে ইরাকি বাহিনীর পক্ষে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। ইরাকি বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করার জন্য খাররাজি যে কৌশল অবলম্বন করে তা বেশ প্রশংসিত হয় এবং তিনি যে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করেন সেটি ‘লায়ন লাইন’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।  কমান্ডার খাররাজির নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা কয়েক মাসের প্রচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে আহওয়াজ-আবাদান মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা ইরাকি বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হন। ওই সাফল্যের মাধ্যমে সামেনুল আয়েম্মে নামক অভিযানের পথ সুগম হয়; যে অভিযানের মাধ্যমে আবাদান শহরের ওপর থেকে ইরাকি বহিনীর অবরোধ ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়।    (মিউজিক)

১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে কারখে এলাকা দিয়ে তারিকাল কুদস অভিযান শুরু করা হয় এবং এর মাধ্যমে ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে  গুরুত্বপূর্ণ বাস্তান শহর মুক্ত করা সম্ভব হয়। ওই অভিযানে ইরাকি বাহিনীর সমরাস্ত্রসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।  এই অভিযানে ইরানি বাহিনীর কমান্ডারের ভূমিকায় ছিলেন শহীদ হোসেইন খাররাজি। যুদ্ধ পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা এতটা সমৃদ্ধ হয়েছিল যে, কমান্ডারদের রণকৌশল প্রণয়নের যেকোনো বৈঠকে তার প্রস্তাব গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হতো। খাররাজির রণকৌশলের একটি সাধারণ দিক ছিল।  যখনই কোনো অভিযানের সময় ও স্থান নির্ধারিত হতো তখন তিনি তার বাহিনীর কমান্ডার থেকে শুরু করে সাধারণ সিপাহী- সবার মতামত গ্রহণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সবার মতামত গ্রহণ করলে অভিযানের পরিকল্পনা প্রণয়নে কোনো ত্রুটি থাকে না এবং পরামর্শদাতারা সবাই অভিযানে তাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে গর্ববোধ করে।

শহীদ খাররাজির নেতৃত্বাধীন  ইমাম হোসেইন ব্রিগেড খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযান বায়তুল মোকাদ্দাসেও অংশগ্রহণ করে।  ওই অভিযান সম্পর্কে ইরানের তৎকালীন সেনাপ্রধান শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি বলেন: প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্যে খাররাজি ওয়াকিটকির মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমাকে বলে: স্যার, আমি এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য নিয়ে শহরে প্রবেশ করতে চাই। আমি তাকে বলি: এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য নিয়ে কয়েক ডিভিশনের মোকাবিলা করা যায় কি? কিন্তু সে তার দাবিতে অটল থাকে এবং আমি কি বুঝে অনুমতি দিয়ে দেই। এক ঘণ্টা পরে খাররাজি আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, ইরাকিরা আত্মসমর্পণ করেছে। আমার প্রথমে বিশ্বাসই হতে চায়নি একথা। কারণ, এটি কোনো বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা ছিল না। যাই হোক, ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযোনে ১৯ হাজার ইরাকি সেনা আত্মসমর্পণ করেছিল।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ