নভেম্বর ০৪, ২০২৩ ১৭:১৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কমান্ডার শহীদ হোসেইন খাররাজির বীরোচিত অবদান নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের জিকির বা আল্লাহর স্মরণ নিয়ে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

আমরা এর আগে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধাদের ঈমান, তাকওয়া ও ইবাদত পালনে একনিষ্ঠতা নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রকৃত অর্থেই ওই যুদ্ধে ইরানি সৈনিকেরা জিকিরের কথা ভুলে যাননি বরং সব সময় আল্লাহকে স্মরণে রেখেছেন। ইরানি যোদ্ধাদের কাছে যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের চেয়ে জিকিরের গুরুত্ব ছিল বেশি। তারা যেমন আল্লাহকে স্মরণ করতেন তেমনি যুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের ব্যাপারেও তাদের আশা ছিল অনেক বেশি। এ কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির দেওয়া অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সুপ্রশিক্ষিত ইরাকি বাহিনীর মোকাবিলায় সামান্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়েও ইরানি যোদ্ধারা উচ্চ মনোবলের অধিকারী ছিলেন।

এ সম্পর্কে ইরানের অন্যতম সেনা কমান্ডার খোদ্দাম হোসেইনি বলেন: “নিঃসন্দেহে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে সমরাস্ত্রসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে শত্রু  আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু তারপরও ওই যুদ্ধে আমরা ছিলাম বিজয়ী। এর কারণে ছিল ইরানি যোদ্ধাদের ঈমান ও ইখলাস বা আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ইবাদতে একনিষ্ঠতা। আমাদের বিজয়ের চাবিকাঠি ছিল ইখলাস।” ইরানি যোদ্ধাদের আধ্যাত্মিক গুণে গুণান্বিত হয়ে ওঠার এই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় তাদের লিখিত ওসিয়তনামায়।  প্রায় সব যোদ্ধাই নিজেদের ওসিয়তনামা বা মৃত্যুর আগের শেষ আকাঙ্ক্ষাগুলো লিখে তারপর যুদ্ধে যেতেন কিংবা যুদ্ধের ময়দানে অবসর সময়ে এই ওসিয়তনামা লিখতেন। এসব ওসিয়তনামায় তারা যুদ্ধে আগমনের কারণ লিখে গেছেন।

সেখানে তারা লিখেছেন যে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে তারা রণক্ষেত্রে এসেছেন। তাদের লক্ষ্য ইসলাম ও কুরআনকে রক্ষা করা, ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি শাসনব্যবস্থা এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। যারা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের রেখে যাওয়া এসব ওসিয়তনামা সংগ্রহ করে সেগুলো বই আকারে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এরকম একজন শহীদ তার ওসিয়তনামায় লিখেছেন: হে আল্লাহ! তুমি তো জানো আমি শুধুমাত্র তোমাকে রাজি-খুশি করার জন্য রণাঙ্গণে এসেছি। আমি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকে শহীদদের পবিত্র রাস্তায় উৎসর্গ করছি।” আরেকজন শহীদের ওসিয়তনামায় এসেছে: “ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমি যুদ্ধে আসিনি। আমি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাঁকে খুশি করা এবং তাঁর নির্দেশ পালন করতেই যুদ্ধে এসেছি এবং এখানে অন্য কোনো লক্ষ্য আমার কল্পনায়ও স্থান পায়নি।”

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরেকজন শহীদ তার ওসিয়তনামায় লিখে গেছেন: “হে আল্লাহ! হে পরওয়ারদিগার! আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ অর্জন করতে আমি যুদ্ধে আসিনি। ক্ষমতা, অর্থ কিংবা পার্থিব জীবনের মূল্যহীন চাকচিক্য লাভ করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি রণাঙ্গণে এসেছি বিশ্বের কাফির শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করতে।”

ইরানি যোদ্ধারা নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করতেন। ইরাকি বাহিনীর হাতে বন্দি ইরানি যোদ্ধারা বন্দি জীবনের কঠিন দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করার মাধ্যমে বন্দিত্বের দুঃখ ভুলে থাকতেন। এসব বন্দি তাদের স্মৃতিকথায় বিষয়টি লিখে রেখেছেন।

এরকম একজন ইরানি বন্দি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “কখনও কখনও মনে হতো ইরাকি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা আসলে অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। কখনো মনে হতো, বন্দিশিবিরের বাইরে আসলে কোনো পৃথিবী বা জীবনই নেই। আমরা ওই জীবনটি শুধু স্বপ্নেই দেখে থাকি। আমরা ওই সময় অন্তরের ভেতর এমন এক শূন্যতা অনুভব করতাম যা কেবল আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে পূরণ হতো।”

পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও মুনাজাতে মশগুল থাকার মাধ্যমে ইরানি যোদ্ধারা আল্লাহর জিকির বা তাঁকে স্মরণ করার চেষ্টা করতেন।  নামাজ হচ্ছে আল্লাহকে স্মরণ করার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। মুমিন বান্দারা নামাজের মাধ্যমে এই ধুলির ধরা ছেড়ে আসমানে পাড়ি জমায় এবং আল্লাহ তায়ালার কাছাকাছি চলে যায়। অপবিত্রতা ও অশুভ সবকিছুকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সৌন্দর্য ও পবিত্রতার আশ্রয় নেয়।

নামাজের মাধ্যমে মানুষ অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করে। ফলে অন্তরের সব অশান্তি, উদ্বেগ, ভয়, শঙ্কা দূর হয়ে যায়। ঠিক এ কারণে মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে চরম দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণের পাশাপাশি নামাজের কাছে আশ্রয় চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যেসব সমস্যা সংকুল অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নামাজের আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে সেসবের মধ্যে যুদ্ধ অন্যতম। কাজেই একজন মুমিন যোদ্ধা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একই সময়ে নামাজের মাধ্যমে যুদ্ধ-জয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা আল্লাহ কাছে সাহায্য চাওয়ার এ কাজটি সূচারুরূপে পালন করেছেন। তারা নিজেদের শিবিরগুলোকে নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের পূর্ণাঙ্গ ঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন।

ইরানি যোদ্ধাদের শিবিরগুলো পরিদর্শনকারী সাংবাদিকরা বলেছেন, সংঘর্ষের সময় ছাড়া অন্য সময়গুলোতে ইরানি যোদ্ধারা নিজ নিজ শিবিরে আল্লাহর জিকিরে বিশেষ করে নফল নামাজে বেশি মশগুল থাকতেন। নামাজের মাধ্যমে তারা নিজেদের অন্তরকে শান্ত করার পাশাপাশি ঐশী শক্তিতেও বলীয়ান হয়ে নিতেন। ইরানি কমান্ডাররা মনে করতেন, ফরজ নামাজগুলো সময়মতো আদায় করার পাশাপাশি বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করলে যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কে একজন ইরানি যোদ্ধা বলেন: ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘সাহেবুজ্জামান’ নামক অভিযানে আমাদের কমান্ডাররা প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্যেও নামাজ আদায় করতে ভুলতেন না। এ সম্পর্কে ইরানি কমান্ডার- জেনারেল কুচানি সম্পর্কে একটি ঘটনা তার অধীনস্ত যোদ্ধারা বর্ণনা করেছেন। 

একজন যোদ্ধা ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে: আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের চতুর্থ দিনে দু’পক্ষের মধ্যে ভয়ঙ্কর লড়াই চলছিল। চারদিক থেকে শুধু গোলা এসে পড়ছিল। আমি সহযোদ্ধাদের প্রত্যেকের চেহারায় শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাচ্ছিলাম। সবাই শাহাদাতাইন পড়ে নিয়েছিলেন। জেনারেল কুচানি আমাদের কমান্ডার ছিলেন এবং তিনি নিজে কয়েক কিলোমিটার দূরে থেকেও যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমাদের সবার অগ্রভাগে থেকে শত্রুর মোকাবিলা করছিলেন। প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্যে জোহরের নামাজের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবাই ওজু করে এক এক করে নামাজ আদায় করে নাও।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/এমবিএ/৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ