নভেম্বর ০৫, ২০২৩ ১৫:৫২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের জিকির বা আল্লাহর স্মরণ নিয়ে নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো। (মিউজিক)

আমরা এর আগে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি বীর কমান্ডার শহীদ হোসেইন খাররাজি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। খাররাজি একটি ডিভিশনের কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও যেকোনো অভিযানে সবার অগ্রভাগে থাকতেন এবং শত্রুসেনাদের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য একাকী ছদ্মবেশে আগ্রাসী বাহিনীর শিবিরে চলে যেতেন।  এরকম দুঃসাহসী কাজ করতে গিয়ে তিনি কয়েক বার আহত হন এবং একবার তার বাম হাতটি উড়ে যায়। শাহাদাতের মুহূর্তেও তিনি ইরাকের বসরা শহরের পূর্বে কারবালা-৫ অভিযানে নিজের অধীনস্ত বাহিনীর কাছে রসদ সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছিলেন। অধীনস্তদের প্রতি ইরানি কমান্ডারদের এই ভালোবাসা ও ত্যাগ স্বীকারের প্রতিদান হিসেবে তারা পেয়েছেন সহযোদ্ধাদের সম্মান ও কৃতজ্ঞতা। সহযোদ্ধারা তাদের কমান্ডারদের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকতেন।

‘পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের পরতে পরতে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানি সৈনিকদের সাহসিকতা ও বীরত্বের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট সুসজ্জিত ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরান কীভাবে বিজয়ী হলো তা জানার জন্য ইরানি যোদ্ধাদের বর্ণনা একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এসব স্মৃতিকথা পড়লে বোঝা যায়, যেকোনো যুদ্ধে একটি বাহিনীর হাতে সমরাস্ত্র তুলে দিলেই হয় না বরং সেসব অস্ত্র পরিচালনার জন্য সাহসী যোদ্ধা প্রয়োজন। আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় দেখা গেছে, শুধুমাত্র একটি গ্রেনেড হাতে থাকা একজন ইরানি যোদ্ধার ভয়ে ভীতু ইরাকি সেনারা সুসজ্জিত ট্যাংকসহ পালিয়ে যাচ্ছে।

ইরাকের বসরা শহরের পূর্বে কারবালা-৫ অভিযান সম্পর্কে সাইয়েদুশ শুহাদা ব্রিগেডের একজন যোদ্ধা বলেন: অভিযানের এক পর্যায়ে আমাদের উপর শত্রুদের হামলা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার অজোরলু ভাই আহত হন। ইরাকি বাহিনী হামলার জন্য কিছু কমান্ডোকে কাজে লাগায়। ফলে পরিস্থিতি আমাদের জন্য আরো জটিল হয়ে যায়।  কমান্ডোরা আমাদের এতটা কাছে চলে আসে যে, আমাদের যোদ্ধাদের একাংশ পিছু হটতে বাধ্য হন। এ সময় আমাদের একজন দীর্ঘদেহী যোদ্ধা টিলার আড়ালে লুকিয়ে থাকেন এবং ইরাকি কমান্ডোরা কাছাকাছি এলে হঠাৎ এক কমান্ডোর উপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার গলায় ছুরি বসিয়ে দেন। এই দৃশ্য দেখে ইরাকের বাকি কমান্ডোরা হতচকিত হয়ে প্রথমে পিছু হটে যায় এবং পরক্ষণে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের প্রাথমিক দিনগুলোতে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খোররামশাহরের তরুণ ও যুবকরা অদম্য সাহসিকতা প্রদর্শন করে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। একটি ঘটনায় খোররামশাহরের তরুণরা মলোটভ ককটেল, রাইফেল গ্রেনেড এবং কয়েকটি আরপিজি দিয়ে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর ৩২টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া ধ্বংস করেন। এখানে ১৩ বছর বয়সি কিশোর ‘রাসূল নূরানি’ একটি রাইফেল গ্রেনেডের সাহায্যে একটি ইরাকি সামরিক যানে হামলা চালালে সেটিতে থাকা পাঁচ ইরাকি সেনা নিহত হয়। রাসূল নূরানি পরবর্তীতে এক অভিযানে শাহাদাতবরণ করেন।

যুদ্ধের ময়দানে কখনও কখনও অল্প কয়েকজন ইরানি যোদ্ধা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বহু সেনাকে বন্দি করে ফেলতেন। বায়তুল মুকাদ্দাস নামক যে অভিযানের মাধ্যমে খোররামশাহর মুক্ত হয়েছিল তাতে মাত্র ১৫ জন ইরানি যোদ্ধা প্রায় দুই হাজার ইরাকি সেনাকে বন্দি করেছিলেন। হুরুল আজিম এলাকায় চালানো বদর অভিযানে ১৬/১৭ বছর বয়সি ১৭ জন ইরানি যোদ্ধা শত্রু  শিবিরে হানা দিয়ে তাদের একশ জনকে আটক করে ফেলেন। পরে ইরাকি বাহিনীর হাতে আটক দুই ইরানি পাইলটকে মুক্ত করার শর্তে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।

ইরাকি সেনাদের বর্ণনায় ইরাকি যোদ্ধাদের সাহসিকতার কাহিনী আরো চমকপ্রদ। একজন ইরাকি সেনা কর্মকর্তা ইরানি যোদ্ধাদের বীরোচিত প্রতিরোধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে: “ইরানি যোদ্ধারা কোনো কিছুকেই ভয় পায় না। একেকজন ইরানি যোদ্ধা একেকটি বোমার চেয়েও বিপজ্জনক। আমাদের সেনারা যখন ইরানি যোদ্ধাদের ঈমানি চেতনা ও বীরত্ব প্রত্যক্ষ করত তখন তাদের হাঁটু কাঁপত এবং তারা যুদ্ধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলত।” (মিউজিক)

আরেকজন ইরাক সেনা কর্মকর্তা ইরানি যোদ্ধাদের বীরত্ব সম্পর্কে বলেন: “আল্লাহর কসম, ইরানি যোদ্ধারা বাজপাখির মতো শিকারের সন্ধান করে। তারা একের পর এক শিকার ঘায়েল করতে থাকে। অথচ আমাদের নিজেদের সেনাদের মধ্যে এর উল্টো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।” আরেকজন ইরাকি অফিসার খোররামশাহরে ইরানি যোদ্ধাদের আক্রমণ ও শহরটি পুনরুদ্ধার সম্পর্কে বলেন: “ইরানি যোদ্ধারা যখন খোররামশাহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন আমাদের ধারনা ছিল আমাদের পাল্টা হামলায় তারা শিগগিরই পশ্চাদপসরণ করবে। কারণ, তাদের সামনে মাইনসহ নানা ধরনোর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিলাম আমরা। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো তাদের বীরত্বের সামনে একের পর এক অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং তারা বীরবীক্রমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে।

ইরাকি সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ইহসান আল-মিকদাদি ইরানের পক্ষ থেকে চালানো খাইবার অভিযান এবং মাজনুন দ্বীপপুঞ্জ দখল সম্পর্কে বলেন: “রাসায়নিক বোমাবর্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে চারদিক থেকে কামানের গোলাবর্ষণ এবং আকাশে হেলিকপ্টার গানশিপ ওড়ার শব্দ ভেসে আসে। হেলিকপ্টারে করে রাসায়নিক বোমা আকাশে পাঠানো হয় যাতে তা নিক্ষেপ করে ইরানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলা যায়। হেলিকপ্টার থেকে ইরানি বাহিনীর উপর রাসায়নিক হামলা শুরু হয়ে যায়। এসব বোমাবর্ষণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, গোটা এলাকার আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। প্রথমে মনে হয়েছিল, সব ইরানি সৈন্য নিহত হয়েছে। কিন্তু পর মুহূর্তে ইরানিদের পাল্টা হামলায় আমার ব্রিডেগের সেনারা নাস্তানাবুদ হয়ে যায় এবং আমাদের তিনজন অফিসার নিহত হয়।

বাস্তান শহর মুক্ত করার লক্ষ্যে ইরান ফাতহুল মোবিন নামক যে অভিযান চালিয়েছিল সে সম্পর্কে  ইরানের হাতে আটক একজন ইরাকি যুদ্ধবন্দি বলেন: “আমাদের সেনারা আপনাদের একদল সৈন্যর বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে লিপ্ত হন। আপনাদের যোদ্ধারা একটি পরীখার ভেতরে বসে প্রতিরোধ করছিলেন। আমাদের প্রায় ৬০০ সেনা ওই পরীখায় হামলা চালায়। ইরানি যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল মাত্র আটজন। অথচ এই আটজন ৬০০ সেনার বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। আমরা তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য তাদের ওপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মারি। কিন্তু তারা আমাদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড কুড়িয়ে আমাদের দিকেই আবার ছুঁড়ে মারে। তাদের এই কৌশলে আমাকের কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এ অবস্থায় আমরা ইরানি যোদ্ধাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলি কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথায় কান দেয়নি। ঠিক তখন আমাদের পক্ষ থেকে দু’টি ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় এবং একটি ট্যাংক ওই পরীখার মধ্যে নিজের গোলাবর্ষণের নল ঢুকিয়ে দেয়। এ পর্যায়ে ইরানি যোদ্ধাদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/এমবিএ/ ৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ