নভেম্বর ০৭, ২০২৩ ১৭:৩১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি কমান্ডার শহীদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতের অবদান নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে হেম্মাতের নেতৃত্বাধীন ‘২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ ব্রিগেডের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি কমান্ডাররা সাহসিকতা, বীরত্ব ও সৃজনশীলতার অভূতপূর্ণ উদাহরণ পেশ করেন। এসব কমান্ডারের বেশিরভাগের বয়স ছিল ত্রিশের কোটায়। পাশাপাশি তাদের কারোই প্রচলিত সামরিক কলাকৌশল জানা ছিল না। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার কারণে তারা স্বল্পতম যোদ্ধা ও সমরাস্ত্র নিয়ে বড় বড় সফল অভিযান পরিচালনা করেন। গত আসরে আমরা ২৮ বছর বয়সি এরকম একজন কমান্ডার মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতকে নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালানোর আগে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী কুর্দিস্তান প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা মাথাচারা দিয়ে ওঠে। ইরানের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয় ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকার।

ইরানের যেসব সেনা কমান্ডার ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন তাদের অনেকেই পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কুর্দিস্তানে ইসলামি বিপ্লব বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমনের কাজে অংশ নিয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। ইরাকি বাহিনী যখন ইরানে আগ্রাসন চালায় তখন শহীদ হেম্মাত ইরানের উত্তরাঞ্চলে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণে যুদ্ধের প্রথম এক বছর তাকে ইরাকি বাহিনীকে প্রতিহত করার কাজে ডাকা হয়নি। এরপর যখন তাকে ডাকা হয় তখন ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশে আগ্রাসী বাহিনীর সঙ্গে ইরানি যোদ্ধাদের তুমুল লড়াই চলছিল। ইরানের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড তখন আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর দখলে। শহীদ হেম্মাতের পাশাপাশি এ সময় কুর্দিস্তান থেকে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানসহ ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির আরো কিছু চৌকস সেনা কমান্ডারকে ইরাকের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তলব করা হয়।

ইরাকিরা ইরানের যেসব ভূখণ্ড দখল করেছিল সেগুলো পুনরুদ্ধার করা ছিল কুর্দিস্তান থেকে এসব সেনা তলবের মূল কারণ। কুর্দিস্তানে সফলভাবে দায়িত্ব পালনকারী ইরানি সেনা কমান্ডাররা মিলে গঠন করেন ‘২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ব্রিগেড। যেসব কমান্ডার এই ব্রিগেড গঠনে ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে শহীদ হেম্মাত, আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ও মাহমুদ শাহবাজি ছিলেন অন্যতম। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের নেতৃত্বে মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্রিগেড গঠিত হয়। মোহাম্মাদ শাহবাজি ও মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতকে এই ব্রিগেডের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজধানী তেহরানের অধিবাসী যেসব তরুণ ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধ করতে যেত তাদেরকে এই ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত করা হতো। এই ব্রিগেডে রিক্রুট করা যোদ্ধাদের আন্দিমেশ্‌ক শহরের নিকটবর্তী দোকুহে নামক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এই ব্রিগেড গঠিত হওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ফাতহুল মোবিন অভিযান পরিচালনা করা হয়  এবং সে অভিযানে ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্রিগেড অসামান্য অবদান রাখে। হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসিলায়ের অভিজ্ঞ নেতৃত্বে ব্রিগেডের যোদ্ধারা কৌশলে ইরাকি বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করেন এবং শত্রুদের কাছ থেকে ৮০টি দূরপাল্লার কামান গনিমতের মাল হিসেবে হস্তগত করেন।  অভিযানে এই ব্রিগেডের নয়টি ব্যাটেলিয়ন চার ধাপে ইরাকি বাহিনীর ওপর চরম আঘাত হানে এবং ইরাকি বাহিনীর হাতে বেদখল হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে। এরপর ২৭ ব্রিগেড দ্বিতীয় যে অভিযানটিতে অংশ সেটি হচ্ছে ‘ইলা-বায়তুল মুকাদ্দাস’।  ফাতহুল মোবিন অভিযানের এক মাস পর এই অভিযানটি চালানো হয় এবং এই অভিযানে ২৭ রাসূলুল্লাহ ব্রিগেড ১২ টি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে যুদ্ধে নামে। ব্রিগেডটি শত্রুসেনাদের ১৭ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে এবং আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে তারা খোররামশাহরের দিকে যাত্রা শুরু করে।

এরপর এই ব্রিগেড শালামচে এলাকায় শত্রুসেনাদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে দিয়ে খোররামশাহর মুক্ত করে।  ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ ব্রিগেড পরবর্তী পর্যায়ে শত্রু বাহিনীকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে এবং তাদের পালানোর পথ রুদ্ধ করে দেয়। এই অভিযানে ব্রিগেডের উপ প্রধান মাহমুদ শাহবাজি শহীদ হন এবং ইব্রাহিম হেম্মাতকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

১৯৮২ সালে ইহুদিবাদী ইসরাইল লেবাননে আগ্রাসন চালালে লেবাননের প্রেসিডেন্ট দেশটিকে সামরিক সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান।  কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ছাড়া তার এই আহ্বানে বিশ্বের আর কোনো দেশ সাড়া দেয়নি।  ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) লেবাননের প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক বার্তায় ইসরাইলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি এ ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর নীরবতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

এ সময় ইসরাইলি আগ্রাসনের মোকাবিলায় লেবানন ও ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ষা করার জন্য ইরান সিরিয়ার মাধ্যমে লেবাননে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সম্পর্কে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির তৎকালীন কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি বলেন: “আমরা সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলিম দেশগুলোর সামনে নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে চেয়েছি এবং তাদেরকেও পরোক্ষভাবে লেবাননে সেনা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছি। আমরা আমাদের সেরা বাহিনীকে লেবাননে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং সেই বাহিনী অন্য কোনো বাহিনী নয় বরং ২৭ মোহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্রিগেড। দু’টি কারণে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রথমত, ফাতহুল মোবিন ও বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযানে এই ব্রিগেডের সামরিক দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই ব্রিগেডের সবাই ছিল রাজধানী তেহরানের অধিবাসী। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কেও তারা সম্যক অবহিত ছিল।”

ইরানের সেনা কমান্ডারদের পরামর্শ অনুযায়ী ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্রিগেডকে সিরিয়া ও লেবাননে পাঠানো হলেও পরে ইমাম খোমেনী এক নির্দেশে, আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে দেশরক্ষা করাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল সেনাকে সিরিয়া ও লেবানন থেকে প্রত্যাহার করতে বলেন। ইমামের নির্দেশে বেশিরভাগ সেনাকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে ব্রিগেড কমান্ডার হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান লেবাননের শিয়া মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে থেকে যান এবং ইসরাইলপন্থি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে অপহৃত হন। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতকে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। শাহাদাতের আগ পর্যন্ত শহীদ হেম্মাত এই গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, দেখতে দেখতে ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ