নভেম্বর ০৮, ২০২৩ ১৬:৪৩ Asia/Dhaka

আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে শহীদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতের নেতৃত্বাধীন ‘২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ ব্রিগেডের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হোর অঞ্চলে পরিচালিত খায়বার অভিযান নিয়ে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ওয়ালফাজর অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন এবং এই অভিযানে ইরানের দুটি ব্যাটেলিয়নের সকল যোদ্ধা অসহায়ভাবে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। ইব্রাহিম হেম্মাতের নেতৃত্বাধীন ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ডিভিশনের দু’টি ব্যাটেলিয়ন ছিল কুমাইল ও হানজালা। এই দুই ব্যাটেলিয়ানের যোদ্ধারা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশরক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। এই দুই ব্যাটেলিয়ানের যোদ্ধারা একটি পরীখা খনন করে সেখান থেকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। কিন্তু ইরাকি সেনারা এক সময় পরীখার কাছে পৌঁছে যায় এবং পরীখার ভেতরে থাকা ইরানি যোদ্ধাদের সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করে। এরপর আগ্রাসী সেনারা পরীখাটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলে; যার কারণে ইরানি যোদ্ধাদের লাশ মাটিচাপা পড়ে যায়।

পরবর্তীতে এলাকাটি ইরান পুনরুদ্ধার করার পর পরীখাটি পুনঃখনন করে ইরানি যোদ্ধাদের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। এ সময় দেহাবশেষের পাঁজরের ভাঙা হাড় দেখে অনুমান করা হয় যে, এসব এসব দেহের উপর দিয়ে ট্যাংক ও বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিল ইরাকি বাহিনী।

ওয়ালফাজর অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর ইরানি সেনা কমান্ডাররা ইরাকি বাহিনীর দুর্বল দিকগুলোর সন্ধান করতে থাকেন। ইরানের পক্ষ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস নামক সফল অভিযান পরিচালনা করার পর ইরাকের সাদ্দাম বাহিনী ইরানের অনেকগুলোর রণকৌশল জেনে গিয়েছিল। ফলে তারা একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি প্রতিহত করার জন্য পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযানের পথে বিভিন্ন ধরনের মাইন ও কাঁটাতার পুতে রাখার পাশাপাশি কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত ও বেশ গভীর পরীখা খনন করে রাখে।

ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকার যখন বুঝতে পারে যে, যুদ্ধের ময়দানে তারা ইরানকে পরাজিত করতে পারবে না তখন সে তৎকালীন সোভিয়েন ইউনিয়ন ও ফ্রান্সের কাছ থেকে দূরপাল্লার যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে। এসব যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়ে সীমান্তের সংঘাতকে ইরানের অভ্যন্তরে নিয়ে আসার চেষ্টা করে বাগদাদ। সেই সঙ্গে সাদ্দাম সরকার ইরানের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর পাশাপাশি ইরানের তেল রপ্তানির প্রধান বন্দর ‘খার্‌ক’-এ হামলা চালায়। খারক বন্দর দিয়ে তেল রপ্তানি করে ইরানের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি যুদ্ধের ব্যয় মেটানো হচ্ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে ২৭ ডিভিশনের কমান্ডার মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কমান্ডাররা ইরাকি বাহিনীকে পরাস্ত করতে অভিনব ধরনের অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন।

ইরানি সেনা কমান্ডাররা ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী হাজি ইমরান এলাকায় ওয়ালফাজর-১ ও ওয়ালফাজর-২ অভিযান চালান। সেইসঙ্গে ইরান-ইরাক সীমান্তবর্তী মেহরান এলাকায় ওয়ালফাজর-৩ এবং ইরাকের পাঞ্চভিন এলাকায় ওয়ালফাজর-৪ অভিযান চালানো হয়। এসব ছোট ছোট অভিযান চালিয়ে ইরাকি বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা হয় যাতে ইরান খায়বার নামক বড় অভিযান পরিচালনা করতে পারে। সীমান্তবর্তী হোর এলাকায় অভিযানটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত হোর এলাকাটি ইরাকের বসরা ও আম্মারা প্রদেশের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ছিল।  

খায়বার অভিযানের জন্য হোর এলাকাটি বেছে নেয়ার কয়েকটি কারণ ছিল। সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এটির বেশিরভাগ অংশ ছিল জলাশয় এবং এ ধরনের ভূমিতে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ইরাকি বাহিনীর ছিল না। হোর এলাকাটির পানির উচ্চতা ছিল পারস্য উগসাগরের পানির উচ্চতার সমান এবং কোথাও কোথাও এটির পানির উচ্চতা ছিল সাগরের পানির চেয়েও দুই তিন মিটার বেশি।  এছাড়া এই জলাশয় পরিপূর্ণ ছিল ঘন নলখাগড়ায়। ফলে যেকোনো স্থান দিয়ে ইচ্ছা করলেই মানুষের পক্ষে চলাচল করা সম্ভব হতো না বরং আগে ছোট নৌযান নিয়ে চলতে চলতে যে পানিপথ তৈরি হয়েছিল সেগুলো দিয়েই যাতায়াত করতে হতো। এরকম একটি পরিস্থিতিতে হোর অঞ্চলে অবস্থিত মাজনুন দ্বীপ দখল করার লক্ষ্যে খায়বার অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা হয়। রমাজান অভিযানের পর তখন পর্যন্ত খায়বার ছিল ইরানের পক্ষ থেকে চালানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান।

ইরানের খুজিস্তান প্রদেশের দক্ষিণে এবং ইরাকের বসরা প্রদেশের উত্তর ও পূর্ব অংশে অভিযানটি পরিচালনা করা হয়। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অভিযানটি শুরু করা হয়। অভিযানের জন্য অন্তত ৫০০ নৌকা প্রস্তুত করা হয়। এসব নৌকার বেশিরভাগেই কোনো ইঞ্জিন ছিল না। ইরানের অন্যান্য স্থান থেকে যোদ্ধাদেরকে অভিযানস্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৮০টি ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে মাত্র ২৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। 

খায়বার অভিযানটি ছিল তার আগ পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। এই অভিযানের সাত মাস আগে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ইউনিটগুলোকে জলাশয়ে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়। বস্তুত হোর এলাকাটিকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় আইআরজিসি।

ইরাক-ইরান আট বছরব্যাপী যুদ্ধে ইরান বহুবার এরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এবং এসব পরিস্থিতিতে ইরানি সেনা কমান্ডারদের সৃজনশীল প্রতিভাকে কাজে লাগানো না হলে এবং যুদ্ধের প্রচলিত কৌশল অবলম্বন করা হলে এ যুদ্ধের ফলাফল ইরানের প্রতিকূলে চলে যেতে পারত। কারণ, ইরাকের পক্ষে ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং আঞ্চলিক আরব দেশগুলিও ছিল বাগদাদের পৃষ্ঠপোষক। পক্ষান্তরে এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইরানকে তো কোন সহযোগিতা করতই না বরং তেহরানের বিরুদ্ধে নানামুখি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানের যুদ্ধ করার ক্ষমতাই কেড়ে নিয়েছিল।  ইরানের বিরুদ্ধে এত বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল যে, শত্রু সেনাদের অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য ইরান আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত কিনতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে কালোবাজার থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে ইরানকে তার প্রয়োজনীয় অস্ত্রসস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হতো।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, দেখতে দেখতে ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ