গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন: তুরস্ক ও আরব দেশগুলোর ভূমিকা (পর্ব-এক)
গাজার হামাস যোদ্ধাদের 'আল-আকসা তুফান' সামরিক অভিযান এবং গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরুর পর এক মাস পেরিয়ে গেছে। ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ গণহত্যা চালালেও আরব দেশগুলো ও তুরস্ক এখন পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং কেবলমাত্র গাজা সংকটের বিষয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক ও আরব সরকারগুলোর এই ধরনের নির্লিপ্ত ও অকার্যকর অবস্থান গাজায় গণহত্যা বন্ধে কতটা প্রভাব ফেলবে এবং মুসলিম সরকারগুলোর কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত? সেটাই এখন সবার প্রশ্ন।
হামাস আন্দোলনের সামরিক শাখা আল-কাস্সাম ব্রিগেড গত ৭ অক্টোবর দখলদার ইসরাইলের অভ্যন্তরে দুঃসাহসিক 'আল-আকসা তুফান' সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে এটাই ছিল ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয় ও অপমানজনক ঘটনা। এরপর ইসরাইল চরম প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে যার মূল লক্ষ্য হলো গাজাকে ফিলিস্তিনমুক্ত করা এবং গাজার উত্তরাঞ্চল দখল করে হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করা। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, গাজায় নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে যার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই হচ্ছে শিশু, মহিলা এবং বয়স্ক মানুষ। ইসরাইল সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্র, আবাসিক এলাকা, শরণার্থী শিবির এবং স্কুলে বোমাবর্ষণ করছে। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেসও এই অপরাধের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, 'আমি আতঙ্কিত।' কেননা গাজায় জাতিসংঘের প্রায় ৭০ জন কর্মী নিহত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছে, ' নীচে বর্ণিত যেকোনো একটি কাজ করলে তা গণহত্যা হিসাবে বিবেচিত হবে। জাতিগত কিংবা ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠীর সমস্ত বা একটি অংশকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত অপরাধযজ্ঞ গণহত্যা বলে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনে পাঁচ ধরনের কর্মকাণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচিত। যেমন,
ক) একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, খ) গোষ্ঠীর সদস্যদের শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করা, গ) ইচ্ছাকৃতভাবে একটি গোষ্ঠীকে অনুপযুক্ত জীবনযাপনের দিকে ঠেলে দেয়া যা ওই গোষ্ঠীর সমস্ত বা আংশিক শারীরিক শক্তির অবনতির দিকে নিয়ে যায়, ঘ) গোষ্ঠীতে জন্ম রোধ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া এবং ঙ) শিশুদেরকে এক দল থেকে অন্য দলে জোরপূর্বক স্থানান্তর। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী ইসরাইল গাজায় এই পাঁচটি অপরাধের সাথেই জড়িত।
এবারে, গাজা সংকটের বিষয়ে আরব দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। তিক্ত বাস্তবতা হলো, গাজা উপত্যকার নিপীড়িত জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকার অন্যতম বড় কারণ হলো এই দখলদার শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আরব সরকারগুলোর নমনীয় ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং তাদের মৌখিক ঘোষণা বা বিবৃতি প্রদান। ইসরাইল গাজার জনগণের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে অথচ আরব দেশগুলো কেবলমাত্র মৌখিক নিন্দা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, কুয়েত, ওমান, জর্ডান, বাহরাইন, ইরাক, সিরিয়া এবং লেবাননসহ অন্যান্য দেশও গাজার জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের নিন্দা করেছে। আরব দেশগুলো গাজার উত্তরাঞ্চলের জনগণকে জোর কোরে অন্যত্র অভিবাসনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তারা ইসরাইলের নৃশংস বোমা হামলার কারণে গাজার লাখ লাখ মানুষের অন্যত্র অভিবাসনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তবে, কাতার এখনো হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে আলোচনার জন্য মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা সফল হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের বাধা ও বিরোধিতার কারণে। ফিলিস্তিনিদের বারবার অনুরোধ এবং গাজার সবচেয়ে খারাপ মানবিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও মিশর রাফাহ ক্রসিং পয়েন্ট পুরোপুরি চালু করতে অস্বীকার করে। আরও দুঃখজনক বিষয় হল, হামাসের কিছু কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমনকি বেশ কয়েকটি আরব দেশ হামাসকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা ও ইসরাইলের সাথে একমত হয়েছিল।
আরব জাতীয়তাবাদের দাবীদার এই দেশগুলো গাজার বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানালেও, ইয়েমেনের হুথি সমর্থিত ন্যাশনাল স্যালভেশন সরকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। এ ছাড়া, লেবাননের হিজবুল্লাহও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, ইরাক ও সিরিয়ার ইসলামি প্রতিরোধ শক্তিগুলোও এই দেশগুলোতে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে।
যদিও হামাসের তুলনায় হিজবুল্লাহর আক্রমণ ব্যাপক ছিল না কিন্তু তারপরও ইসরাইল গাজা সংলগ্ন দক্ষিণ ফ্রন্ট থেকে তার বাহিনীর একটি বড় অংশ কমিয়ে আনে এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর হুমকি মোকাবেলায় ইসরাইলের উত্তর ফ্রন্টে তাদের মোতায়েন করে। গত ১২ নভেম্বর শুক্রবার হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এক ভাষণে ঠিক এ বিষয়টির কথা উল্লেখ করে আরো বলেছেন, 'ইসরাইলের বিমান বাহিনীর এক চতুর্থাংশ লেবানন সংলগ্ন উত্তর সীমান্তে পাঠানো হয়েছে এবং ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রায় অর্ধেকও লেবাননের সীমান্তের দিকে মোতায়েন রয়েছে। যদি আমাদের অবস্থান শুধুমাত্র লোক দেখানো সংহতি হতো, তাহলে ইসরায়েল লেবানন সংলগ্ন উত্তর সীমান্তে নিশ্চিত হতে পারতো এবং সমস্ত সেনা গাজায় পাঠাতো।'
এবারে আমরা গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের ব্যাপারে তুরস্কের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরাইলের ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে একটু কঠোর অবস্থানে গেছেন। এরদোগানের এই অবস্থানটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে হামাসের আল-আকসা তুফান সামরিক অভিযানের আগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার পদক্ষেপ নিয়েছিল এরদোগান সরকার। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, 'হামাস কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়-বলে আমার বক্তব্যে ইসরাইল অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আমি আবারও বলছি যে হামাস কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়, যদিও অনেকে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে মনে করে।'
এরদোগান আরও বলেছেন, 'যারা ইউক্রেনের জন্য মায়াকান্না করেছে তারা এখন গাজার ঘটনায় সম্পূর্ণ নীরব। যারা গতকাল পর্যন্ত ইউক্রেনের নৃশংসতার জন্য কাঁদছিল, আজ তারা ইসরাইলকে সমর্থন করছে এবং তাদের হাত রক্তে রঞ্জিত।'
এরদোগান আরো বলেছেন, 'ইসরাইল পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ছাড়া তিন দিনও টিকতে পারবে না, আমরা বিশ্বের কাছে ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে উপস্থাপন করবো এবং গাজায় এখন যা ঘটছে তা ইসরাইলের আত্মরক্ষা নয় বরং নৃশংস হত্যাকাণ্ড। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।