নভেম্বর ১৪, ২০২৩ ১৮:২৩ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা আল ফারাবির চিন্তা-গবেষণা ও রচনাসামগ্রীর মাধ্যমে আরেক বিখ্যাত মনীষী ইবনে সিনার প্রভাবিত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। তবে, ইবনে সিনা ছাড়াও, ফারাবি অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদেরও প্রভাবিত করেছেন, যাদের প্রতি খুব কমই দৃষ্টি দেয়া হয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন ইবনে মাসকুইয়েহ যার দুটি বই "আল-তাহারে" ও "তাহযীব আল-আখলাক" এর কথা উল্লেখ করা যায়।

ইবনে মাসকুইয়েহ এরিস্টটলের কাছ থেকে যা কিছু পেয়েছেন তা নিয়েছিলেন ফারাবির মাধ্যমে। ইবনে মাসকুইয়েহ তার রচনায় ফারাবির নীতিশাস্ত্রকে ব্যবহার করেছেন। বলা যায় যে, ইবনে মাসকুইয়েহ তার মধ্যপন্থী তত্ত্বে অ্যারিস্টটল দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু তার সেই তত্ত্বের বিশ্লেষণে এবং তার ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি ফারাবি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।  অন্য কথায়, বলা যায় ইবনে মাসকুইয়েহ-এর নীতিশাস্ত্র বিশেষ করে সংযম, সৌভাগ্য ও বরকত তত্ত্ব ফারাবির মতামত ও চিন্তাদর্শন থেকে উদ্ভূত। উদাহরণস্বরূপ, তিনি 'সাহসিকতা'কে রাগ বা ক্রোধ থেকে আসা শক্তির একটি গুণ হিসাবে বিবেচনা করেন এবং 'ন্যায়বিচার'কে একটি কল্যাণ হিসাবে বিবেচনা করেন যা জ্ঞান, সাহস ও পুণ্য এই তিনটি গুণের মিলনের ফল।

এই প্রতিটি গুণের ব্যাখ্যা ইবনে মাসকুইয়েহ এমনভাবে উল্লেখ করেছেন যেখানে ফারাবির গভীর প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে তিনি বিশ্বাস করেন যে এই গুণগুলো প্রশিক্ষণ ও অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জিত হয়। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করেননি যে এই গুণগুলো প্রাকৃতিক এবং সহজাত, তবে বিশ্বাস করেছিলেন যে সেগুলো অর্জিত বিষয় ঠিক যেমনটা বিশ্বাস করতেন ফারাবি। 'সত্যিকারের কল্যাণ' সম্পর্কে বিশ্লেষণে ইবনে মাসকুইয়েহ আল-ফারাবী থেকেও স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরেছেন।  ফারাবীর মতো তিনিও বিশ্বাস করেন যে চিরস্থায়ী সত্তা চিরকাল বেঁচে থাকে এবং যখন একটি সত্তা এমন পরিপূর্ণতার স্তরে পৌঁছে যে স্থায়ীভাবে যে কোনো উৎস থেকে অনুগ্রহ গ্রহণ করার প্রবণতা থাকে, যা তার জন্য সর্বোচ্চ মর্যাদা বয়ে আনে, আর এটাই চূড়ান্ত সুখ বা সৌভাগ্য। এছাড়াও, ফারাবীর মতো ইবনে মাসকুইয়েহ বিশ্বাস করতেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই স্তরগুলো তাদের লক্ষ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে ততক্ষণ পর্যন্ত পুণ্য অর্জনের মাধ্যমে সুখ বা সৌভাগ্য অর্জন করা যায় আর দিগন্তের এই প্রান্তটি হল ফেরেশতাদের প্রথম দিগন্ত, যা মানুষের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তর।

যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে, পোরফিরিওসের পর ফারাবি ছিলেন অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা তুলে ধরার ক্ষেত্রে বড় উদ্যোক্তা। তিনি মুসলিম বিশ্বে ও ইসলামি দর্শনে অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই ফারাবির পর সব যুক্তিবিদই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফারাবির দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন করেছেন। এই যুক্তিবিদ্যার অংশ হচ্ছে অ্যারিস্টটলীয় যুক্তি, যা ফারাবিকে পরবর্তী মুসলিম মনীষীদের কাছে ফারাবি তত্ত্ব নামে পরিচিত করে তোলে।

যাইহোক, অন্যান্য আরো অনেক দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ফারাবীর চিন্তাদর্শন ও তার গবেষণা কর্মের কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে ইবনে রুশদ, গাজ্জালী, শাহরেস্তানি, ইবনে সাবাঈন, ইবনে তাইমিয়া, হাজেম কারতাজনি, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি সোহরাওয়ার্দী, সায়েদ আন্দালুসি, ইবনে বাজাহ খাজেরি, মিরদামাদ, মোল্লা সাদরা, শামসাই গিলানি, আবদুর রাজ্জাক লাহেজি, ফয়েজ কাশানি প্রমুখ চিন্তাবিদ ও মনীষীদের নাম উল্লেখ করা যায়।

এই চিন্তাবিদদের মধ্যে কেউ কেউ ফারাবির ভক্ত ছিলেন এবং কেউ কেউ যেমন গাজ্জালি, শাহরেস্তানি, ইবনে বাখায়ে, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে হাজার বা মুহাম্মদ বাকের মাজলেসি ছিলেন ফারাবির শত্রু ও বিরোধী। তবে, ফারাবিকে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা দেখুক না কেন উভয়ে ফারাবির মতামত ও চিন্তাদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ফারাবির ভক্তরা নীতিশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যায় ফারাবীর বক্তব্যগুলোকে নিজেদের বইয়ে নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। যারা ফারাবীর রচনাগুলো পড়েছেন এবং ব্যবহার করেছেন, তাদের খুব কমই তাদের লেখায়  ফারাবির নাম উল্লেখ করেছেন। ইমাম রাজী, শামসুদ্দিন সমরকান্দি এবং কুতুব রাজীর মতো ব্যক্তিরা ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব যাদের যুক্তিবিদ্যার বইগুলো ফারাবীর যুক্তি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। ফারাবীর রচনার অনুকরণকারী এবং তার ভক্তদের মধ্যে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছে আবু হায়ান তৌহিদী, আবু সুলাইমান সাজেস্তানি, আবুল হাসান মোহাম্মদ আমেরি, জালালুদ্দীন মোহাম্মদ দাওয়ানি, গিয়াসুদ্দিন মনসুর দাশতেগী, সুলতান উলামায়ে ইসফাহানি এবং ইবনে খাতুন আমিলি। 

এমন অনেক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যারা  ইতিহাসে খুব একটা পরিচিত নন আবার এমন অনেক অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে যার মধ্যে ফারাবির চিন্তাগবেষণার গভীর প্রভাবের চিহ্নগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কের আসাদ এফেন্দি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত 'জামাল আল-ফালসাফেহ মা'আনি বি'জুমা' নামে ১৪১৮ নম্বর একটি পান্ডুলিপির কথা উল্লেখ করা যায়, যার লেখক তালকিস মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আল-হিন্দি। এতে তিনি ফারাবির প্রচুর উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন।

এ ছাড়া, আমরা আব্দুল লতিফ বিন ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন আলী বাগদাদীর 'আন-নাসিহাতিন আন-নাস কাফে' বইটির কথাও উল্লেখ করতে পারি, যেখানে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের উদ্ধৃতি উল্লেখ করার সময় লেখক ফারাবির মাধ্যমে ব্যাপক প্রভাবিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

ফেনোমেনোলজি, যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র এবং এমনকি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসহ ইহুদি দর্শনের অনেক বিষয়ে ফারাবির ব্যাপক প্রভাব অনেক গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফেনোমেনোলজি একটি দর্শন যা মানুষের ব্যক্তিত্বের বাস্তবতার প্রতি এবং তার ব্যাখ্যাগুলোর উপর মনোযোগ প্রদান করে। ফেনোমেনোলজি ক্ষেত্রে, ফারাবির গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ 'এহসা আল-উলূম' যা ইহুদি দার্শনিকদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে এবং প্রায় ১২০০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেশ কিছু ইহুদি পণ্ডিতকে প্রভাবিত করেছে। এই পণ্ডিতদের মধ্যে একজন হলেন 'জোসেফ বিন জুদাহ ইবনে আকনিন' যিনি ছিলেন মরক্কোর একজন ইহুদি পণ্ডিত। তিনি ১২২৬ সালে মারা যান। জোসেফ বিন জুদাহ বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মূসা বিন মাইমনের ছাত্রদের একজন ছিলেন। তিনি দর্শনে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনিও ছিলেন ইসলামি দর্শনের অন্যতম খ্যাতিমান মনীষী ফারাবী ও ইবনে সিনার শিষ্যদের একজন।

এ ছাড়া, ফারাবির আরেক ভক্ত ইউসুফ বিন ইয়াহভেহ তার "তাব আল-নুফুস" বইতে যা নীতিশাস্ত্রের একটি বই তাতে সরাসরি ফারাবির বইয়ের বড় অংশ উদ্ধৃত এবং বর্ণনা করেছেন। তিনি দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এমনকি সঙ্গীতে ফারাবীর কাজের অনেক কিছু এবং বৈচিত্র্যময় অংশের পুনরাবৃত্তি করেছেন যা ফারাবীর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রমাণ বহন করেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ