নভেম্বর ১৯, ২০২৩ ১৫:৪৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হোর অঞ্চলে পরিচালিত খায়বার অভিযানের সূচনা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই অভিযানের বাকি অংশ এবং এতে ইরানের কয়েকজন সেরা কমান্ডারের শাহাদাত সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরান যেসব সফল অভিযান চালায় সেগুলোর মধ্যে ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে চালানো খায়বার অভিযান ছিল অন্যতম। ইরান ও ইরাকের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত মাজনুন দ্বীপ দখলের লক্ষ্যে ওই অভিযান চালানো হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থলভাগে যুদ্ধ করার পর ইরানি কমান্ডাররা এবার জলভাগে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারা অভিযান চালানোর জন্য দু’দেশের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী হোর অঞ্চল বেছে নেন যে অঞ্চলের ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩০ কিলোমিটার প্রস্থ এলাকাজুড়ে রয়েছে শুধু জলাশয়। খায়বার অভিযানকে প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সবচেয়ে দীর্ঘ ও কঠিনতম উভচর অভিযান হিসেবে অভিহিত করা হয়।  তেলসমৃদ্ধ মাজনুন দ্বীপ দখল করা এবং বসরা-বাগদাদ মহসড়ক বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ছিল খায়বার অভিযানের দুটি মূল উদ্দেশ্য। 

অন্যদিকে হোর অঞ্চলে ইরানি সৈন্যদের যেকোনো উপস্থিতি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না ইরাক। এ কারণে অভিযানের প্রথম প্রহরেই ইরানি যোদ্ধারা মাজনুন দ্বীপ দখল করে নেওয়ার পর একটানা ৭২ ঘণ্টা ধরে প্রবল গোলাবর্ষণ করে যায় ইরাকি বাহিনী। এই তিন দিনে ইরাকি বাহিনী মাজনুন দ্বীপ লক্ষ্য করে ১৫ লাখ গোলা নিক্ষেপ করে বলে অনুমান করা হয়। গোলাবর্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান দিয়েও ইরানি সেনা অবস্থানে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছিল ইরাকি সেনারা। কিন্তু তারপরও ইরানি যোদ্ধারা এসব পরিস্থিতি মাথায় রেখেই মাজনুন দ্বীপ দখল করেছিলেন বলে তারা পূব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিরোধ চালিয়ে যান। ইরানের পরিকল্পনা ছিল ইরাকি বাহিনীর বড় ধরনের ক্ষতি করে যুদ্ধের লাগাম পরিপূর্ণভাবে নিজের হাতে নিয়ে নেওয়া।

খায়বার অভিযানে ইরানের তরুণ যোদ্ধাদের প্রতিরোধের প্রশংসা করে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর তৎকালীন প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) মোহসেন রেজায়ী বলেন, “মাজনুন দ্বীপে ইরানি যোদ্ধারা অভূতপূর্ব প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ওই দ্বীপ থেকে আমাদের মূল ভূখণ্ডের দূরত্ব ছিল ২০ কিলোমিটার। এই ২০ কিলোমিটার পথ নৌকায় করে অতিক্রম করে আমাদের যোদ্ধাদের কাছে রসদ সরবরাহ করতে হতো। অন্যদিকে, ইরাকের মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপটির দূরত্ব ছিল মাত্র তিন কিলোমিটার। ফলে তাদের পক্ষে অতি সহজে মাজনুন দ্বীপে আসা কিংবা সেখানে গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। শত্রু সেনারা আমাদের কাছ থেকে দ্বীপটি পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু এতসব হামলা সত্ত্বেও ইরানি যোদ্ধারা দ্বীপটি ত্যাগ না করে বরং সেখানে অবস্থান করে প্রতিরোধ চালিয়ে যান।”

এ অবস্থায় ইরাকি বাহিনী ইরানি যোদ্ধাদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। অথচ এই নিষিদ্ধ অস্ত্র দিয়ে হামলার শিকার হওয়ার ব্যাপারে ইরানের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ কারণে ইরানি যোদ্ধারা খায়বার অভিযানে রাসায়নিক অস্ত্রবিরোধী কোনো পোশাক বা সরঞ্জাম নিয়ে যাননি। খায়বার অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ সম্পর্কে ইরাকি সেনা কমান্ডার কর্নেল এহসান আল-মিকদাদি বলেন: “আমরা কামানের গোলা এবং যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করি। কিছুক্ষণের মধ্যই দ্বীপটির আকাশ রাসায়নিক অস্ত্রের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আমাদের যে সেনবাহিনীকে দ্বীপে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল আমি তাদের নেতৃত্বে ছিলাম। ইরানি সৈন্যরা রাসায়নিক অস্ত্রে মারাত্মক কাবু হয়ে যাওয়ার পর আমরা হামলা শুরু করি। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ইরানি সৈন্যরা প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আমাদের ওপর প্রচণ্ড বেগে পাল্টা হামলা চালায়। ফলে আমাদের হামলা ব্যর্থ হয় এবং আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই।”

খায়বার অভিযানে আইআরজিসির বেশ কয়েকজন কমান্ডারসহ অসংখ্য যোদ্ধা শহীদ হন। ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ডিভিশনের কমান্ডার হাজি ইব্রাহিম হেম্মাত ও এই ডিভিশনের উপ কমান্ডার আকবার যাজাজি এই অভিযানে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। ইব্রাহিম হেম্মাত এই অভিযানের সময় একটানা কয়েকদিন বিশ্রামহীন ও অভুক্ত অবস্থায় শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে তার অধীনস্ত যোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হেম্মাত জীবনের শেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত নিজ বাহিনী পরিচালনা করে আসছিলেন। একবার তিনি প্রচণ্ড ক্ষুধা ও নিন্দ্রাহীনতার কারণে বেহুঁশ হয়ে পড়েন এবং তাকে ফিল্ড হাসপাতালে ভর্ত করতে হয়। যখন তার হুঁশ আসে তখন তিনি হাতে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হন।

তড়িৎকর্মা, শক্তি, কর্তৃত্ব এবং সহনশীলতা ছিল ইব্রাহিম হেম্মাতের কিছু ইতিবাচক গুণ। এসব গুণের কারণে শাহাদাতের তিন দশকেরও বেশি সময় পর এখনও হেম্মাতের নাম প্রতিটি ইরানির অন্তরে সমুজ্জ্বল।  হেম্মাত খায়বার অভিযানের সময় তার অধীনস্ত যোদ্ধাদের বলেছিলেন: আমাদেরকে প্রতিরোধ করে যেতে হবে যাতে শত্রুরা আমাদের দখলীকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে না পারে। আমরা হয় সবাই শহীদ হয়ে যাব অথবা যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে মাজনুন দ্বীপ দখলে রাখব।

খায়বার অভিযানে হামিদ বাকেরি নামে ইরানের আরেকজন কমান্ডার শাহাদাতবরণ করেন। আশুরা ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডার শহীদ বাকেরিও জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে যান।

শহীদ হামিদ বাকেরি মৃত্যুর আগে যে ওসিয়তনামা লিখে যান তাতে বলা হয়েছে: “আমরা ইমামের নির্দেশে ইমাম হোসেইনের মতো যুদ্ধ করতে এসেছি এবং তাঁরই মতো শহীদ হয়ে যাবো।” এই খায়বার অভিযানে ১৪ ইমাম হোসেইন ব্রিগেডের কমান্ডার হোসেইন খাররাজির একটি হাত উড়ে যায়। এছাড়া, মাজনুন দ্বীপে শাহাদাতবরণ করেন ইরানের আরো বহু সৈনিক ও কমান্ডার।  শেষ পর্যন্ত মাজনুন দ্বীপটি ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগ পর্যন্ত ইরানের দখলে ছিল। ‌১৯৮৪ সালের গোড়ার দিকে ইরান ইরাকের মাজনুন দ্বীপ দখল করার পর বাগদাদের পাশাপাশি তার আন্তর্জাতিক মিত্ররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।  তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজিনেস্কি বলেন: “চলমান যুদ্ধে ইরাক পরাজিত হলে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  ইরাকের পরাজয়ে কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজ পারস্য উপসাগরের পরিস্থিতি আনপ্রেডিক্টেবল অবস্থায় পৌঁছে গেছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

 

ট্যাগ