নভেম্বর ২০, ২০২৩ ২১:০৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের বিজয়ে ঈমানি শক্তির ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে ইরানের পক্ষে অদৃশ্য বা ঐশী সাহায্য সম্পর্ক আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান ইরানি যোদ্ধাদের দেহ ও মনজুড়ে বিশাল বৃক্ষের ন্যায় বদ্ধমূল ছিল। আর ওই বৃক্ষের ডালপালা যুদ্ধের ময়দানে তাদেরকে শীতল ছায়া যোগাতো। আর এই বৃক্ষের ফল ছিল ইরানি যোদ্ধাদের উন্নত মানবিক  গুণাবলী। সমকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ প্রেম, ভালোবাসা, পরোপকার, আত্মত্যাগ ও উন্নত মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ঘটেছিল।ইরানি যোদ্ধারা উন্নত মানবীয় গুণাবলী এবং আত্মত্যাগের কারণে অনেকগুলো অভিযানে জয়লাভ করেছিলেন। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ঈমানী চেতনা বদ্ধমূল থাকার কারণে ইরানি যোদ্ধারা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।  তিনি এক ভাষণে যোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা ভাববেন না যে, সামরিক শক্তির কারণে আপনারা টিকে আছেন। আপনাদের জেনে রাখা উচিত ঈমানি শক্তি আপনাদেরকে টিকিয়ে রেখেছে।”

ইরাকিদের হাতে বন্দি হওয়া একজন ইরানি যোদ্ধা বলেন: “আমি ইরাকি বন্দিশিবিরে থাকার সময় রেডক্রসের একজন কর্মী আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এ সময় আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, বলুন তো মানুষের দেহ বেশি শক্তিশালী নাকি লোহা? তিনি জবাব দেন: লোহা। তখন আমি তাকে আবার জিজ্ঞাসা করি: আমি এই বন্দিশিবিরে থাকার অবস্থায় এখানকার লোহার তৈরি কাঁটাতারের বেড়াগুলো কতোবার জং ধরে ক্ষয় হয়ে গেল অথচ আমি এখনও মানসিক ও শারিরীকভাবে সুস্থ আছি। এটি কীভাবে সম্ভব হলো? রেড ক্রসের কর্মীটির মুখে কোনো জবাব ছিল না। তখন আমি নিজেই তাকে উত্তর দিলাম: একমাত্র আল্লাহর ও দ্বীনের প্রতি ঈমান আমাদেরকে এরকম সুস্থ ও সতেজ রেখেছে।

ইরাকি বন্দিশিবিরে আটক আরেকজন ইরানি যোদ্ধা বলেন, বন্দিশিবিরগুলোতে ইরাকিদের চরম নির্যাতন সহ্য করার জন্য মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আমাদেরকে শক্তি ও সাহস যোগাত। ঈমানি চেতনা না থাকলে ওই অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান থাকার কারণে ইরানি যোদ্ধারা অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছিলেন। একজন ঈমানদার মানুষ গায়েবি মদদ বা ঐশী সাহায্যে বিশ্বাস করেন। তিনি সর্বাবস্থায় একথা বিশ্বাস করেন যে, ঈমান ও সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অটল থাকলে ঐশী সাহায্য পাওয়া যাবেই। ঐশী সাহায্য এমন এক পুঁজি যা ঈমানদার ব্যক্তিকে সব সময় সাহস যোগায়।  পক্ষান্তরে ঈমানহীন কাফির ব্যক্তি এ ধরনের কোনো কিছুতে যেমন বিশ্বাস করে না তেমনি ঐশী সাহায্য তার কপালে জোটেও না।

একজন মানুষ যদি একথা বিশ্বাস করতে পারে যে, সে যে কাজে নেমেছে তাতে মহান আল্লাহ তার পৃষ্ঠপোষকতা করছেন এবং যেকোনো বিপদে আপদে তিনি তাকে সাহায্য করবেন তখন সে তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছা পর্যন্ত অত্যন্ত নির্ভীক চিত্তে তার কাজ করে যেতে পারে।

তারিকুল কুদস অভিযানের মাধ্যমে বাস্তান শহর পুনরুদ্ধার করার পর ইমাম খোমেনী ইরানি যোদ্ধাদের এক সমাবেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, “আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন যারা তাকে সাহায্য করবে তিনিও তাদেরকে সাহায্য করবেন। মহান আল্লাহ জানেন যে, আমরা তাঁর দ্বীন রক্ষার উদ্দেশ্যে লড়াই করছি এবং আমরা পৃথিবীর বুকে তাঁর হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করতে চাই। এই পথে জীবন দানকারী শহীদগণ বাহ্যিকভাবে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং সশস্ত্র বাহিনীর অবশিষ্ট সদস্যরা ওই পথে চলা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা যখন দ্বীন প্রতিষ্ঠা জন্য লড়াই করছি তখন আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেনই।”

ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীও আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণ না করে বরং প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতাকে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য পাওয়ার আশার ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন। তিনি বলেন: একজন মুসলমানদের পক্ষে আগ্রাসন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।আমরা যদি চতুর্দিক থেকে সর্বাত্মক আগ্রাসনেরও শিকার হই তারপরও নতিস্বীকার করা আমাদের ধাঁতে নেই। আমাদেরকে শক্তি যোগায় পবিত্র কুরআনের সূরা মুহাম্মাদের এই আয়াত। [ইংতাংসুরুল্লাহা ইয়াংসুর্‌কুম অয়ুসাব্বিত আকদামাকুম। অর্থাৎ] যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে তিনিও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাগুলোকে সুদৃঢ় করবেন। আমরা যেহেতু বিশ্বাস করি যে, আমরা আল্লাহকে সাহায্য করছি তাই আমরা নিশ্চিত যে, তাঁর সাহায্য আসবেই।” 

ইরানের সেনা কমান্ডাররা আট বছরের যুদ্ধে বহুবার এরকম ঐশী সাহায্য প্রত্যক্ষ ও অনুভব করেছেন।  ইরানের সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল শহীদ সাইয়্যাদ সিরাজি খোররামশহর পুনরুদ্ধারের অভিযান সম্পর্কে বলেন: “ওই অভিযানে আমরা কয়েকবার এমন চরম পরিস্থিতিতে পড়েছি যে, সমস্ত বাহ্যিক হিসাব নিকাশ বলছে যে, এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু পরমুহূর্তে আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে চলে এসেছে। একমাত্র ঈশী মদদই আমাদেরকে ওই অভিযানে বিজয় এনে দিয়েছিল।” তিনি আরো বলেন, “ওই অভিযানে নদী পারাপারের সময় কিংবা ইরাকিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়ক অতিক্রমের সময় অথবা সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থানে আগ্রাসী সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর সময় আমরা ঐশী সাহায্যের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে অনুভব করেছি। যখনই আমরা গায়েবি মদদের বিষয়টি উপলব্ধি করতাম তখনই আল্লাহর দরবারে শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায় করতাম।

আট বছরব্যাপী পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ঐশী মদদ সম্পর্কে ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্রিগেডের কমান্ডার শহীদ ইব্রাহিম হেম্মাত বলেন: “আল্লাহ তায়ালাকে সাহায্য করলে তিনিও আমাদেরকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার বাস্তবায়নে কোনো সংশয় নেই। অবশ্য মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে পরীক্ষা করেন।  আমাদেরকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে এবং আল্লাহর সাহায্যের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমরা যেসব অভিযানে জয়ী হয়েছি তার প্রত্যেকটিতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহায্য করেছেন।” মহান আল্লাহ বদর যুদ্ধে ফেরেশতাদের দ্বারা মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করার পর সূরা আলে ইমরানের ১২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “আর এটা তো আল্লাহ তোমাদের জন্য শুধু সুসংবাদ ও তোমাদের আত্মিক প্রশান্তির জন্য করেছেন। আর সাহায্য তো শুধু পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কাছ থেকেই হয়।”

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ এমবিএ / ২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ