ডিসেম্বর ০৪, ২০২৩ ১৮:৩৩ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-১৩)

গত আসরে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে আমরা পরিবেশবাদী আন্দোলন ও এনজিওর ছদ্মাবরণে ইরানে অনুপ্রবেশ করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করব। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো বলে আশা রাখছি।

গ্রিসের রূপকথায় বর্ণিত ট্রয় নগরীর যুদ্ধ নিশ্চয়ই আপনারা শুনে থাকবেন। ট্রয়ের যুদ্ধ হলো একটি মহাকাব্য যা গ্রীক কবি হোমার যীশু খ্রিস্টের জন্মের আগে ইলিয়াড গ্রন্থে চিত্রিত করেছিলেন। গল্পটা এরকম। গ্রিসের সেনাবাহিনী ১০ বছর অবরুদ্ধ করে রেখেও ট্রয় নগরীর পতন ঘটাতে পারেনি। এ অবস্থায় তারা কাঠ দিয়ে একটি বিশালকায় ঘোড়া তৈরি তার পেটের মধ্যে নিজেদের বেশ কিছু সশস্ত্র কমান্ডোকে রেখে অবরোধ প্রত্যাহার করে চলে যায়। এদিকে ট্রয় নগরীর যোদ্ধারা ধরে নেন যে, তারা গ্রিসের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বলে গ্রিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করে চলে গেছে।

তারা যুদ্ধ জয়ের নিদর্শন হিসেবে গ্রিকদের ফেলে যাওয়া ঘোড়াটিকে টানতে টানতে শহরের ভেতরে নিয়ে যান। ঘোড়াটিকে অরক্ষিত রেখে ট্রয়ের যোদ্ধারা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। এরপর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ট্রয়বাসী যখন রাতে বিজয়ের আনন্দে গভীর ঘুমে অচেতন তখন বিশালকায় ঘোড়াটি থেকে গ্রিসের সশস্ত্র কমান্ডোরা বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে গ্রিসের সেনারা ফিরে এসে ট্রয় নগরীর দরজায় অপেক্ষমান। কমান্ডোরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরীর মূল ফটকে থাকা প্রহরীদের হত্যা করে ফটকটি খুলে দেয়। গ্রিক বাহিনী হুড়মুড়িয়ে নগরীতে অনুপ্রবেশ করে এবং ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে ট্রয় যুদ্ধে বিজয় লাভ করে।

ট্রয় নগরীর মহাকাব্যের ঐতিহাসিক সত্যতা থাকুক আর না থাকুক এই ঘটনা থেকে শত্রুপক্ষের ঘরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করার একটি কৌশল বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান আধুনিক যুগে অনুপ্রবেশ করার ধরন, কৌশল ও সরঞ্জামে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো একটি দেশকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শারিরীকভাবে ওই দেশে অনুপ্রবেশ করার প্রয়োজন নেই। বর্তমান যুগে ওই দেশের মানুষের মনোজগতকে পাল্টে দিয়ে সেখানে নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারনা বসিয়ে দিতে পারাটাই একটি সাফল্য। সফট পাওয়ার সম্পর্কিত তাত্ত্বিক জোসেফ নাইয়ের মতে, আমি যদি এমন কাজ করতে সক্ষম হই যার ফলে আমি যা চাই আপনিও তা কামনা করেন তাহলে ওই কাজ করতে বলপ্রয়োগ করে আপনাকে আর বাধ্য করতে হবে না।

জ্বি, আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি যখন একটি দেশের পক্ষ থেকে আরেকটি দেশে প্রভাব সৃষ্টি বা অনুপ্রবেশ করার নানাবিধ উপকরণ রয়েছে। এ কাজে গণমাধ্যম একটি বড় শক্তি। পাশাপাশি মানবিক সাহায্যের নামে বিজ্ঞান, গবেষণা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও শত্রুর দেশে অনুপ্রবেশ করা যায়। এসব কাজে যুদ্ধের তুলনায় অতি সামান্য খরচ ও লোকবল ব্যয় হয়। ভার্চুয়াল জগতটি ট্রয় নগরীতে রেখে যাওয়া ঘোড়ার মতো কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ সামাজিক মাধ্যম টেলিগ্রামের কথাই ধরা যাক। এই টেলিগ্রাম ইরানি জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য অন্তত তিন হাজার সার্ভারকে কাজে লাগিয়েছে। এছাড়া, ইরানের বাইরে থেকে বহু স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ইরানি জনগণের জন্য বিনা পয়সায় অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এসব চ্যানেল প্রধানত আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রচার করছে এবং এগুলো পরিচালনার টাকা যাচ্ছে পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলো থেকে।

২০২২ সালের শরতে ইরানে যে সহিংসতা চাপিয়ে দেওয়া হয় তার কারণ হিসেবে মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনা ছিল একটি অজুহাত মাত্র। মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণ হিসেবে ওই সব টিভি চ্যানেল প্রথমে একটি কল্পকাহিনী ছড়িয়ে দেয়।  কুর্দি নারী মাহসা আমিনি ইরানের আইন মেনে হিজাব পরতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তাকে আটক করে। এরপর কর্তৃপক্ষ জানায়, শিশুকাল থেকে শরীরে বহন করা একটি রোগের কারণে মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়।  কিন্তু বিদেশি গণমাধ্যমগুলো একথা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে থাকে যে, পুলিশি নির্যাতনে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে।

এরপর ইরানের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হাতে সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় এবং সেসব অস্ত্র দিয়ে তারা ইরানের একটি মাজারে হামলা চালিয়ে নারী ও শিশুসহ বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। ইরানি সমাজে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এদেশের জনগণের মধ্যকার ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার আশায় পশ্চিমা টিভি চ্যানেলগুলো এই অপকর্মে উস্কানি দেয়।

২০১৭ সালে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্রের এক সদস্যকে আটক করে। ওই ব্যক্তি পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক একটি এনজিওর পক্ষ থেকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের কয়েকটি এলাকায় শক্তিশালী ক্যামেরা বসিয়েছিল। কিন্তু আসলে সে ওইসব ক্যামেরার সাহায্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির তথ্যচিত্র ধারণ করে বিদেশে পাচার করছিল।  তাকে আটক করার পর পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তীব্রতর করে।  ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে দাবি করে, ইরানি নিরাপত্তা বাহিনী অহেতুক পরিবেশবাদী দ্বৈত নাগরিকদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। পত্রিকাটি দাবি করে, এসব ব্যক্তি পাশ্চাত্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডিগ্রি লাভকারী এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

প্রখ্যাত মার্কিন কৌশলবিদ মার্ক পালমারকে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে নতুনত্ব আনয়নকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি বলপ্রয়োগ করে ইরানের সরকার পরিবর্তনের বিরোধী। পালমার মনে করেন, সফট ওয়ার চালিয়ে ইরানি জনগণকেই তাদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে এবং তাদের মাধ্যমেই ইরানি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটাতে হবে।

একটি দেশের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যাবলীকে একটি পাজেলের সঙ্গে তুলনা করা যায় যা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের সমন্বয়ে গঠিত। ইরানের অভ্যন্তরে সরাসরি অনুপ্রবেশ করে যেহেতু এদেশের গোপন তথ্য হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় তাই পাশ্চাত্য নানা পদ্ধতিতে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ সংগ্রহ করে তা থেকে একটি গোটা চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করে।

কৃত্রিম উপগ্রহগুলো থেকে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো ইরানের বাহ্যিক তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।  কিন্তু আরো কাছে থেকে কীভাবে এদেশের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা যায়? এজন্য তারা ইরানের ভেতরে ড্রোন পাঠানোর চেষ্টা করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ইরানের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী আরকিউ-১৭০ মডেলের একটি অত্যাধুনিক মার্কিন ড্রোন গুলি করে নামায় ইরান। এছাড়া, বিভিন্ন এনজিও, পরিবেশবাদী আন্দোলন কিংবা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক হিসেবে ইরানে পাঠানো ব্যক্তিদের মাধ্যমে এদেশের গোপন তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় মোটেও কার্পণ্য করে না পাশ্চাত্য।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

 

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ