ডিসেম্বর ০৪, ২০২৩ ১৮:১৮ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-১২)

আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরনের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর ব্যক্তিগত জীবনের একটি শক্তিশালী দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করব। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো বলে আশা রাখছি।

বিগত বছরগুলোতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশেষ করে আমেরিকার প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর মুসলিম বিশ্বে আমেরিকা-বিরোধিতা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববাসীর কাছে আমেরিকা একটি ঘৃণিত নামে পরিণত হয়। মধ্য এশিয়া অঞ্চলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মার্কিন সরকার বিভেদ সৃষ্টি ও অনুপ্রবেশকারী শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। তবে এখানে অনুপ্রবেশকারী শক্তি বলতে গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেয়েও বিপজ্জনক কিছুকে বোঝানো হচ্ছে। আর তা হলো, একটি দেশের সরকার ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে নিজের অনুগামী লোক তৈরি করা।  ২০১৯ সালে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক ভাষণে এ সম্পর্কে বলেন:

“যারা দেশের সাংস্কৃতিক তৎপরতা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন তারা সতর্ক থাকুন। আমরা একটি সর্বাত্মক হামলার মোকাবিলা করছি। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি বিশাল ফ্রন্টে আমাদের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের আগে থেকে জানা ছিল কিন্তু এখন তারা নিজেরাই স্বীকার করছে।  তারা বলছে, ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এখন আর যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না। কাজেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে হবে। মানুষের মস্তিষ্কের ওপর কাজ করতে হবে এবং তাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের জৈবিক চাহিদাকে উস্কে দিতে হবে। এসব কথা এখন তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়ায়।”

একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব সৃষ্টি করা বা হস্তক্ষেপ করার কয়েকটি দিক রয়েছে। এর একটি দিক হচ্ছে সাংস্কৃতিক। অনেকে মনে করেন, দেশে দেশে অধুনা যে  ‘পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি’ বা ‘জনকূটনীতি’ শুরু হয়েছে তা আসলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেরই পরিচ্ছন্ন রূপ। বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সক্ষমতা সম্পর্কে প্রচার চালানো, অর্থনৈতিক কূটনীতির সম্পূরক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা, গণমাধ্যমের জন্য নিয়মিত ব্রিফিং আয়োজন করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত তথ্য তুলে ধরা, গুজব প্রতিরোধ করা, দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার মাধ্যমে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে গণমাধ্যমকে অবহিত রাখা ও আস্থায় আনা জনকূটনীতির কাজ।

১৯৬৫ সালে আমেরিকায় দেশটির প্রখ্যাত কূটনীতিক আলমন্ড গোলিভান প্রথম জনকূটনীতির বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তখন থেকে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এবং নানাভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়ার পর জনকূটনীতি এখন একটি স্বীকৃত কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অবশ্য প্রখ্যাত কূটনীতিক জেন বিগলার জনকূটনীতিকে শুধুমাত্র এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে সীমিত মনে করেন না। তার মতে, অন্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা জনকূটনীতির একটি মূল লক্ষ্য। বিগলার মনে করেন, একটি ভিন দেশের জনগণকে আকৃষ্ট করে সেই দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করার নামই জনকূটনীতি।

তার এই বক্তব্যের গূঢ় রহস্য তখনই আমরা উপলব্ধি করতে পারব যখন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা বা এনএসএ’র সাবেক প্রধান পাওয়েল মিকির বক্তব্য শুনব। তিনি ২০২০ সালে এক বক্তব্যে বলেন, আমরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে ইরানি জনগণ সম্পর্কে নানারকম তথ্য ক্রয় করেছি এবং এ খাতে ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। এ সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যম টেলিগ্রাম জানিয়েছে, তারা ইরানি জনগণের তথ্য বিক্রি করে দৈনিক শত শত কোটি ডলার অর্থ উপার্জন করেছে।  অন্য দেশে প্রভাব বিস্তার করা পশ্চিমা দেশগুলোর সফট ওয়ারের অন্যতম অংশ। একটি দেশের জনগণের পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তাধারা, রুচি ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য জানতে পারলে ওই দেশের জনমতকে সহজেই প্রভাবিত করা সম্ভব।

স্বাভাবিক কূটনীতি আর জনকূটনীতির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- স্বাভাবিক কূটনীতি হয় একটি দেশের সরকার ও আরেকটি দেশের সরকারের মধ্যে। কিন্তু জনকূটনীতিতে একটি দেশের সরকারের পাশাপাশি ওই দেশের গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজসহ এ ধরনের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা হয়। মার্কিন সরকার অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার কিংবা অন্যান্য দেশকে চাপে রাখার জন্য সব সময় এ ধরনের কূটনীতি ব্যবহার করে। ওয়াশিংটন বিভিন্ন দেশে সিনেমার তারকা কিংবা জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদদের প্রেরণ করে কার্যসিদ্ধি করে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকার দেশ সুদানের কথা উল্লেখ করা যায়। ২০১১ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে সুদান দুই টুকরা হয়ে যায়। ওই বিভক্তির অন্যতম মূল হোতা ছিল আমেরিকা। সে সময় সিএনএনের সাংবাদিক জর্জ ক্লোনিকে সুদানের পাঠানো হয় জনকূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে।

তখন গ্লোবাল পোস্ট লিখেছিল: ক্লোনিকে দক্ষিণ সুদানে পাঠানো হয়েছে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কৌশলগত গণভোটকে কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করতে এবং সেখানকার জনগণকে একথা বোঝাতে যে, কী করলে দেশটির গৃহযুদ্ধ বন্ধ হবে এবং তারা একটি শান্তিপূর্ণ দেশের মালিক হবে।

এভাবে আফ্রিকার মুসলিম দেশ সুদানকে ভেঙে দক্ষিণ সুদান নামক একটি খ্রিস্টান দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটানো হয়। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের প্রতি আরব লীগের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বশিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। আর এভাবে তেলসমৃদ্ধ দারফুর অঞ্চলে পশ্চিমাদের পা রাখার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়।  শুধু তেল নয় বিশ্বের তামা ও ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে সমৃদ্ধ খনিগুলো এই দারফুরেই অবস্থিত।

ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মনে করেন, মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ করার একটি প্রধান উপায় হলো এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ও শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। এসব দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি এসব শিক্ষার্থীর মস্তিষ্ক ধোলাই করা।  ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা রুখতে ইসলামি বিপ্লবের পরপরই প্রয়োজনীয় পদক্ষে নেওয়া হয়। এ কারণে আমেরিকা ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। এ কারণে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইরানের বিরুদ্ধে সফট ওয়ার শুরু করেছে। কিন্তু ইরানের ইসলামি সরকারের সতর্ক অবস্থানের কারণে বিপ্লবী এই দেশটির সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না পশ্চিমা শত্রুরা।

আজকের আলোচনা শেষ করব ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর এ সংক্রান্ত একটি বাণী শুনিয়ে। তিনি বলেন, “সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন আমাদের ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি আলেমদের ধ্বংস করার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ে তখন তার ইরানকে আঘাত করার দু’টি পন্থা বেছে নেয়। এর একটি হচ্ছে হুমকি ও ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করা এবং দ্বিতীয়টি নিজস্ব এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে এদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করা।  এরপর যখন তারা দেখল ভয় ও হুমকি দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না তখন তারা প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপ করার দ্বিতীয় অপশনটি বেছে নেয়।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ