ডিসেম্বর ০৪, ২০২৩ ১৯:৪২ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-১৪)

গত আসরে আমরা পরিবেশবাদী আন্দোলন ও এনজিওর ছদ্মাবরণে ইরানে অনুপ্রবেশ করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরানের অর্থনৈতিক খাতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ সম্পর্কে কথা বলব। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো বলে আশা রাখছি।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর থেকে এদেশকে অন্যতম যে বড় সমস্যাটির মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হলো- দেশের অভ্যন্তরে কিছু দেশদ্রোহী মানুষ যারা ইরানের শত্রুদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এসব এজেন্ট এ পর্যন্ত ইরানের বহু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীকে হত্যা করা ছাড়াও একাধিকবার দেশে সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। শত্রুরা ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের যে খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে তা হলো এদেশের অর্থনৈতিক খাত। আধিপত্যকামী শক্তিগুলো তাদের শত্রু দেশগুলোর অর্থনীতির ক্ষতি করার জন্য নানা ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেন: দেশের অর্থনীতির ওপর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শ্যেন দৃষ্টি রাখতে হবে। শত্রুরা যেন ইরানের অর্থনৈতিক খাতে তাদের কোনো এজেন্ট বা অনুপ্রবেশকারী লোক ঢুকিয়ে দিতে না পারে। যেসব দেশে তারা এটি করতে পেরেছে সেসব দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

এজেন্ট বা অনুপ্রবেশ নামক পরিভাষাটি ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝেমধ্যেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। অনুপ্রবেশ হচ্ছে শত্রুর সফট ওয়ারের অন্যতম একটি হাতিয়ার। আধিপত্যকামী শক্তিগুলো বিশ্বের স্বাধীনচেতা দেশগুলোকে বাগে আনতে সেসব দেশের সরকারগুলোর পতন ঘটাতে চায়। এ লক্ষ্যে তারা সামরিক আগ্রাসন, সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা সহিংসতা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এসব কাজের যেকোনোটির জন্য অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয় এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। তবে এর তুলনায় ওই দেশের কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অর্থের বিনিময়ে নিজের এজেন্ট হিসেবে কাজ করাতে পারলে তুলনামূলক বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। এতে ঝুঁকি যেমন নেই তেমনি খরচও অনেক কম। একটি দেশের অর্থনৈতিক খাতে বিদেশি অনুপ্রবেশ হলে তা ওই দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করতে পারে।

গত অর্ধ শতাব্দি জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পশ্চিমা আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড এই হস্তক্ষেপের শিকার দেশগুলোর অন্যতম।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিনের শাসনামলে রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপের উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ইয়েলেতসিন সরকার আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে। ওই আলোচনায় রাশিয়ার পক্ষ থেকে বড় ধরনের কিছু ছাড় দেওয়া হয় এবং কথা হয় যে, এর বিনিময়ে রাশিয়াকে বিশ্বব্যাংক বা এ ধরনের কোনো বড় ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু রাশিয়া তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

বরিস ইয়েলেতসিন সরকার মার্কিন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টা জেফরি স্যাকসের পরামর্শক্রমে রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন। এর ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রাশিয়ার বাজারে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়, বেকারত্ব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, মানুষের চিকিৎসা সেবার মান ভয়াবহভাবে নীচে নেমে আসে, সমাজে অপরাধ বেড়ে যায় এবং জীবনের প্রতি মানুষের হতাশা নেমে আসে। অল্প সময়ের মধ্যে রাশিয়ার অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে তাকে বরিস ইয়েলেতসিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ‘অর্থনৈতিক গণহত্যা’ বলে মন্তব্য করেন।

জেফরি স্যাক্স বিশ্ব ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপদেষ্টা এবং তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে ‘শক থেরাপি’ প্রয়োগ করার অন্যতম প্রবক্তা।  ১৯৮৫ সালে অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত বলিভিয়ায় জেফরি স্যাকসের উদ্ভাবিত শক থেরাপি প্রয়োগ করা হলে দেশটির অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। বেকারত্ব কঠিন আকার ধারন করে এবং বেকার মানুষেরা মাদকদ্রব্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গ্রেফতার হন এবং তাদেরকে অ্যামাজন জঙ্গলের দূরবর্তী কারাগারে পাঠানো হয়। সরকার বিরোধী বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকটি খনির হাজার হাজার কর্মীকে গণবহিষ্কার করা হয়।

জেফরি স্যাকসের অর্থনৈতিক সূত্রগুলো টেকসই উন্নয়ন, ঋণ বিতরণ ও শক থেরাপি নামে পরিচিতি পায়। স্যাকসের অর্থনৈতিক সূত্র বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আর্জেন্টিনা এবং পোল্যান্ডও বিপদে পড়ে যায়।

ইরানের ওপর যখন আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর অর্থনৈতিক যুদ্ধ চলছিল তখন বিগত দশকে এরকম একজন কথিত অর্থনীতিবিদকে ইরানের কোনো কোনো কর্মকর্তা দু’বার আমন্ত্রণ করে এদেশে নিয়ে এসেছিলেন। স্যাক্স একবার এসেছিলেন তেহরানে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব অর্থনীতি ও নিষেধাজ্ঞা’ শীর্ষক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যক্তির অর্থনৈতিক সংজ্ঞা অনুসরণ করে একাধিক দেশের অর্থনীতির ভরাডুবি হয়েছে সেই ব্যক্তি নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে ইরানের অর্থনীতি রক্ষা করতে কী পরামর্শ দিতে পারে? তাহলে কি তার সেই পাশ্চাত্য-পন্থী শক থেরাপি দিয়ে ইরানের অর্থনীতি রক্ষা করা হবে?

যাই হোক, পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করার বা অনুপ্রবেশ করার যে চেষ্টা করে তা গণমাধ্যমের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। একটি দেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পাশাপাশি ওই দেশের সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে গণমাধ্যমের জুড়ি নেই। ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর থেকে এদেশের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা তৈরি করা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইরানের অর্জনগুলো ধামাচাপা দিয়ে রাখার জন্য কোনো কোনো গণমাধ্যম ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ইরানের ভেতরেরই অনেক গণমাধ্যম এ কাজে জড়িত। ইরানের অর্থনৈতিক সমস্যাকে বড় করে তুলে ধরাকেই এসব গণমাধ্যম নিজেদের ব্রত করে নিয়েছে। 

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহণ, তেল ও গ্যাস, শিল্প ও খনিজ সম্পদসহ নানা খাতে ইরান বিগত চার দশকে যে চোখ ধাঁধানো উন্নতি করেছে তা এসব গণমাধ্যমে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অথবা অনেক হাল্কা করে তুলে ধরে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন: “সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা এখন শত্রুর জন্য কোনো সহজ কাজ নয়, অনেক কঠিন। এ কারণে, তারা ইরানের বিরুদ্ধে সফট ওয়ার শুরু করেছে। তারা জনমনে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে খারাপ ধারনা সৃষ্টি করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এ থেকেই আমাদের সামর্থ্য ও শক্তিমত্তার প্রমাণ পাওয়া যায়।”

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ