ডিসেম্বর ০৬, ২০২৩ ১৯:০৫ Asia/Dhaka

পাশ্চাত্য সমসাময়িকদের মধ্যে যারা ফারাবির রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি দার্শনিক লিও স্ট্রাউসের নাম উল্লেখ করা যায়। তবে সেইসাথে এটাও উল্লেখ করা উচিত যে, স্ট্রাউস প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের রাজনৈতিক দর্শন অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ফারাবির প্রতি তার মনোযোগ ছিল ক্ষণস্থায়ী। তিনি একজন দার্শনিক এবং তিনি মুহসেন মাহদিসহ অনেক ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

এ ছাড়া, ইবনে মাইমনসহ অন্য ইহুদি দার্শনিকদের উপরও ফারাবির প্রভাব থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। ফারাবিকে সমসাময়িক পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে স্ট্রাউসের ভূমিকাকেও ছোট করে দেখা যায় না। ফারাবি এবং ইবনে মাইমন পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়া চিন্তাগত সংকটের বিষয়ে অবহিত ছিলেন যা স্ট্রাউস উল্লেখ করেছেন। স্ট্রাউসের মতে, এই সংকট সৃষ্টির কারণ হচ্ছে, দর্শন ও বিজ্ঞানের পৃথকীকরণ এবং আধুনিকতার বিস্তার। 

তাই, ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের দিকে স্ট্রাউসের মনোনিবেশ পাশ্চাত্যে প্রচলিত একাডেমিক শিক্ষাকেন্দ্রের বিশুদ্ধতা নিয়ে তার উদ্বেগের কারণে নয় বরং তার জীবদ্দশায় পশ্চিমের চিন্তাগত সঙ্কট বৃদ্ধি তাকে ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলে ধরেছিল। পাশ্চাত্যের এই ইহুদিপণ্ডিত স্ট্রাউসের উপর মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা আল-ফারাবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দুটি মৌলিক কারণের মধ্যে পাওয়া যায়। একটি হল রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণরূপে প্লেটোনিক প্রকৃতির এবং প্লেটোর চিন্তাধারার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। সেসব দর্শনের জটিল স্তরগুলো বোঝার চেষ্টা করা ছাড়া কেউ বুঝতে পারতো না, কিন্তু ফারাবি এটাকে সহজ করে তুলে ধরেছিলেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ফারাবী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখিয়েছিলেন আর তা ছিল, যেকোনো সমাজে মূর্খ ও জ্ঞানীর মধ্যে যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী কথা বলা উচিত। অর্থাৎ দর্শনের জটিল সত্যগুলো কেবল গুপ্ত পদ্ধতির মাধ্যমেই জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করা উচিত যাতে দার্শনিকের জন্য সক্রেটিসের মৃত্যুর মতো ভাগ্যের পরিণতি ভোগ করতে না হয়। কেননা অজ্ঞরা দর্শনের জটিল তত্ত্বগুলো বুঝবে না। ফারাবির এই দুটি শিক্ষা স্ট্রাউসকে আকৃষ্ট করেছিল।      

স্ট্রাউস উন্নয়ন ও অগ্রগতির আধুনিক ধারণার সমালোচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ফারাবি ও ইবনে মাইমন, ধ্রুপদী দর্শন অনুসরণ কোরে এবং ম্যাকিয়াভেলির সাথে শুরু হওয়া আধুনিক দর্শনের বিরোধিতা করে, সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চাইতেন। তারা প্রজ্ঞা ও সীমাহীন বুদ্ধিবৃত্তিক নীতির উপর ভিত্তিশীল যে সমাজে বাস করতেন সেটাকে কখনই তারা হাতছাড়া করতে চাননি। অন্য কথায় বলা যায়, ফারাবী ও ইবনে মায়মন দর্শনের নতুন নতুন আইডিয়া বা তত্ত্ব তুলে ধরতেন যা ব্যবহারিক দর্শন ছিল না। তারা দর্শন ও প্রজ্ঞার উপর ভিত্তি করে গঠিত সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের যেকোন প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতেন কারণ তারা এ পরিবর্তনকে সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। যদিও প্রগতির ধারণায় বিশ্বাসী আধুনিক শাসকরা, ক্ল্যাসিক বা ধ্রুপদী দার্শনিকদের সমাজকাঠামোর বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং 'প্রগতি' নামে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার কথা ভাবেন।

স্ট্রাউসের মতে, নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারার সমস্ত দুর্বলতাই ধ্রুপদী রাজনৈতিক দর্শনের শক্তি ও সত্যতাকে তুলে ধরেছে। দর্শন ও বিজ্ঞানের ঐক্য, ইউটোপিয়ার যুক্তিবাদী ও দার্শনিক পরিকল্পনা এবং এর ফলে একটি বিশেষ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজচিন্তা এবং ফারাবীর চিন্তাধারায় গ্রীক ও ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন এসবই আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারায় অনুপস্থিত।

কিন্তু স্ট্রাউস ছাড়াও, সমসাময়িকদের মধ্যে যারা ফারাবি নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ও বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন ইরাকি বিজ্ঞানী মোহসেন মাহদি যিনি স্ট্রাউসেরই ছাত্র। মোহসেন মাহদি প্রধানত ফারাবির গবেষণার বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের ওপর গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন এবং পাশ্চাত্যে ফারাবি গবেষণার বিভিন্ন শাখাকে আরো সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন।  

ইরাকি বিজ্ঞানী মোহসেন মাহদি তার ডক্টরেট থিসিসে ইবনে খালদুনের ইতিহাস বিষয়ক দর্শন নিয়ে তার কাজ শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তী বছরগুলোতে এটি প্রকাশের মাধ্যমে তিনি ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামে রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি সকলের কাছে, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে তুলে ধরেন। কিন্তু পরবর্তীতে, ফারাবির রাজনৈতিক দর্শনের আরো গভীরতা ও প্রশস্ততার বিষয়টি উপলব্ধি করে তিনি ইবনে খালদুনকে প্রায় পরিত্যাগ করেন এবং ফারাবীর রাজনৈতিক দর্শনের সাথে আরো পরিচিত হওয়ার জন্য গবেষণা শুরু করেন।

আমরা যদি মোহসেন মাহদির সর্বশেষ লেখা "ফারাবি ও ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিষ্ঠা" নামক বইয়ের দিকে নজর দেই তাহলে দেখতে পাব পাঠকরা এই বিষয়ে ফারাবির গবেষণার গুরুত্ব বিশেষ করে ফারাবির  ইসলামি রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন এবং সর্বোপরি ইসলামকে বুঝবেন। তাই মোহসেন মাহদির চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে হলে তার চিন্তাধারায় বিদ্যমান যুক্তিবাদ এবং ইসলামি শিক্ষায় রাজনীতির সাথে তার সংযোগের বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে।

মোহসেন মাহদির মতে, ইবনে রুশদের পর মুসলিম বিশ্বে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চা ও ঐতিহ্য অব্যাহত থাকলেও এর রাজনৈতিক দিকটি উপেক্ষিত ছিল। তার মতে, হিজরী ১১ শতকের দিকে ইরানের ইসফাহান শহরে মীরদামাদ ও মোল্লা সাদরার মতো দার্শনিকদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত "আল-হিকমাতুল জাদিদেহ" নামক শিক্ষাকেন্দ্রে ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চা ও ঐতিহ্য চালু ছিল যেখানে রাজনৈতিক ইস্যু উপেক্ষিত ছিল। তবে, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর, ফারাবির চিন্তা ও গবেষণাকর্মগুলো ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। কেননা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সাথে প্রজ্ঞাময় শাসন, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও কর্মকাণ্ডের বিষয়টি ওতপ্রতোভাবে জড়িত। 

সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের মতে, ফারাবি এমন একজন চিন্তাবিদ যিনি এই ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদী ও একনায়ক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা তুলে ধরেছিলেন। বহু আলামতে বোঝা যায় ফারাবি ছিলেন একজন শিয়া মুসলিম। বিগত চার দশকের বেশিরভাগ অধ্যাপক, ছাত্র ও গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, ফারাবী বিজ্ঞ শিয়া মুসলিম এবং তিনি যেকোনো ধরনের শাসন ব্যবস্থার চাইত প্রজ্ঞাময় শাসন ব্যবস্থাকে সর্বোত্তম মনে করতেন।

ফারাবি একজন শিয়া মুসলিম হওয়ার কারণে হযরত আলী (আ.)এর প্রজ্ঞাপূর্ণ শাসন ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিলেন যা তার চিন্তাজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। যাইহোক, এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় সমসাময়িক যুগের চিন্তাবিদ ও গবেষকরা ফারাবিকে প্রজ্ঞাময় শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে মনে করেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ