সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ৬১ (নিজেকে সৃজনশীল ভাবুন)
আপনি কতটুকু সৃজনশীল, তা নির্ভর করছে আপনার নিজের ওপরই। আপনি নিজেকে যতটা সৃজনশীল ভাবেন আপনি আসলে ঠিক ততটাই সৃজনশীল। সৃজনশীল হওয়ার জন্য প্রথম শর্তই হচ্ছে আপনাকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, আপনি একজন সৃজনশীল মানুষ।
আপনার ভেতর অফুরন্ত সৃজনশীলতা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৯৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে উঁচু মানের সৃজনশীল হওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী হাভার্ড গার্ডনার পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি মানুষই অন্তত একটা ক্ষেত্রে জিনিয়াস অর্থাৎ একজন মানুষ অন্তত একটা ক্ষেত্রে অসাধারণ সৃজনীশক্তি ও ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। এর মানে হলো আমাদের কারোরই হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদেরকে কেবল এটা খুঁজে বের করতে হবে যে, আমি কোন ক্ষেত্রে জিনিয়াস, আমি কোন ক্ষেত্রে অসাধারণ সৃজনীশক্তির অধিকারী। আমাদের সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য নিজের নির্বাচিত একটি লক্ষ্য থাকা চাই। একইসঙ্গে আপনার সামনে থাকতে হবে কোনো সমস্যা যা আপনি সমাধান করতে চান, পাশাপাশি নিজের ভেতরে থাকতে হবে প্রশ্ন।
আপনি আপনার লক্ষ্যটাকে প্রথমে নিজের কাছেই সুস্পষ্ট করুন। চিন্তাকে ইতিবাচক ধারায় রাখুন। এর ফলে লক্ষ্য পানে এগোতে অনেক বেশি উৎসাহ পাবেন এবং নতুন আইডিয়াও ধরা দেবে সহজে। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলে সৃজনীশক্তি আপনাকে সহযোগিতা করবেই। বলা হয়ে থাকে, সব মানুষ তখনি কেবল সৃজনশীল যখন তার কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে। নিজের কাছে অথবা অন্যের কাছে প্রশ্ন করার মধ্যদিয়ে সৃজনশীলতা বিকশিত করা সম্ভব। প্রশ্ন এমন হতে হবে যাতে আপনাকে তা গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। বিখ্যাত মার্কিন লেখক জিম কলিন্স তার 'গুড টু গ্রেট' নামের বইয়ে লিখেছেন, ভালো কোম্পানির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এসব কোম্পানির নির্বাহী পরিচালকেরা নিজেরাই নিজেদের কাছে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে জানে। তারা নিজেদেরকে এমন সব প্রশ্ন করেন যাতে ঐসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়। আধুনিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তাত্ত্বিক পিটার ড্রাকার বলেছেন, আমি আসলে কোনো পরামর্শক নই বরং আমি কেবল সোজাসাপ্টা কথা বলি। আমি কোনো উত্তর দেই না বরং ব্যক্তির কাছে কেবল কঠিন প্রশ্ন করি যাতে সে বিশেষভাবে তার নিজের জন্য প্রযোজ্য উত্তরগুলো খুঁজে পায়।
সৃজনশীল উপায়ে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধনের পথে অন্যের পরামর্শও আপনাকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে। এ কারণে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। একইভাবে অন্যদেরকে সঙ্গে নিয়েও যৌথভাবে লক্ষ্য পানে এগোতে পারেন। এর ফলে আপনার কাজটা আরও সহজ হয়ে উঠবে এবং অনেকের আইডিয়া একত্রিত হলে সুচারুভাবে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। যৌথভাবে কাজ করলে অন্যের পক্ষে থেকে সমালোচিত হওয়ার ভয়ও কমে যায়। আমরা সাধারণত কোনো কাজ করতে গেলে ছোটখাটো বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। সব দিক বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের মন-মগজও এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আপনি যখন কোনো স্থান থেকে বাড়ি ফিরতে চান। প্রথমেই চিন্তা করেন কোন পথটির দূরত্ব সবচেয়ে কম। কিন্তু বাস্তবে আরও অনেক বিকল্প পথ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা ভাবতে চাই না। আমরা ভাবি না, সবচেয়ে কম দূরত্বের পথে না গিয়ে বিকল্প কোনো পথে এগোলে গন্তব্যে পৌঁছানোর পাশাপাশি নতুন কিছু অভিজ্ঞতাও অর্জিত হবে এবং এই অভিজ্ঞতা আমার অন্য কোনো কাজকে সহজ করে দিতে পারে। এমনও হতে পারে, কম দূরত্বের পথটি পাড়ি দিতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি এবং একটি দুর্ঘটনা আপনাকে বহু পেছনে ঠেলে দিতে পারে। বিকল্প পথ আপনাকে নিরাপদ রাখবে।
কাজেই সব দিক বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যপানে এগোবার মন-মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে এবং এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। আজকের আলোচনার শুরুর দিকে আমরা বলেছি, প্রত্যেক মানুষই অন্তত কোনো একটা ক্ষেত্রে জিনিয়াস অর্থাৎ একজন মানুষ অন্তত একটা ক্ষেত্রে অসাধারণ সৃজনীশক্তি ও ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। একজন ব্যক্তি কোন ক্ষেত্রে জিনিয়াস তা বের করার জন্য বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত ডায়েরি লেখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যাদের প্রতিদিন ডায়েরি লেখার সুযোগ রয়েছে তারা এই টিপসগুলো অনুসরণ করতে পারেন। আসলে নিজের সৃজনশীল সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলার জন্য সবার আগে নিজেকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে৷ আর নিজেকে বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ডায়েরি লেখা। এখানে আপনি নিজে কি চান সেটা বুঝতে পারবেন। নিজের উপলব্ধিকে কলমের মাধ্যমে খাতায় ফুটিয়ে তুলুন৷ খুব সুন্দর ভাষায় লিখতে হবে এমনটা কিন্তু নয়৷ আপনার ডায়েরি আপনি ছাড়া আর কেউ পড়ে না। সুতরাং যা মনে আসে লিখে ফেলুন। নিজেকে বোঝা খুব জরুরি৷ তাই এভাবে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে কি চান সেটা নিরূপণ করুন।
শুধু ডায়েরি লিখলেই যে নিজেকে বুঝে যাবেন এমনটা কিন্তু নয়। যা লিখেছেন সেগুলো পড়ুন। এর ফলে নিজের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবেন। নিজের আগের সপ্তাহের লেখাগুলোও পড়ুন, দেখবেন আপনি ঠিক কি চান সেটা সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট ও পরিপক্ব হয়েছে। নিজেকে চেনার পর এবার নিজে কী কী সবচেয়ে ভালো পারেন সেগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করুন। সেখান থেকে সবচেয়ে ভালো পারেন এমন তিনটি বিষয়কে আলাদা করে লিখে রাখুন। যেমন ধরুন আপনার পছন্দ হলো কুরআন পড়া, গল্প লেখা ও ছবি আঁকা। আপনি বুঝতে পারেন, এগুলো আপনি ভালো পারেন। আজ থেকেই এগুলোর চর্চা শুরু করুন। কয়েক সপ্তাহ এই তিনটি জিনিসই নিয়মিত চর্চা করুন। আপনার সবচেয়ে পছন্দের তিনটি জিনিস নিয়ে আপনি চর্চা করে যাচ্ছেন। এবার এই তিনের মধ্যে কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভালো পারেন সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। তারপর যে বিষয়ে আপনি সেরা সেটা বেছে নিয়ে এগিয়ে যান। যেমন ধরুন গল্প লিখতেই আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে। তাহলে গল্প লেখার পেছনে সময় ব্যয় বাড়িয়ে দিন।
দেখবেন নিজের সৃজনীশক্তির বিকাশ ঘটছে৷ ধীরে ধীরে চর্চার মাধ্যমে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর পর সাহিত্য পত্রিকা বা বিভিন্ন প্লাটফর্মে নিজের গল্পগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করুন এবং অন্যের গল্পও বেশি বেশি পড়ার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিন। আরও দক্ষ হতে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কোর্সের সহযোগিতা নিন। এভাবেই আপনি কোন ক্ষেত্রে জিনিয়াস তা চিহ্নিত করতে পারবেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা সব জীবের মধ্যে সেরা। মানুষ নিজের বুদ্ধি ও সৃজনশীলতা দিয়ে অনেক কিছু জয় করেছে। মানুষ তার সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেকে এবং নিজের জীবনকে উন্নত করে যাচ্ছে। সৃজনশীলতার কোনো সীমা নেই। তবে ব্যক্তি বিশেষে তার তারতম্য ঘটতে পারে। আসুন আমরা সবাই আমাদের সৃজনশীলতা বিকাশে চেষ্টা করি, চেষ্টা করলে সবাই পারবেন।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।