ডিসেম্বর ১৯, ২০২৩ ১৭:২১ Asia/Dhaka

গত দুটি পর্বের আলোচনায় আমরা ফারাবির জীবনে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার অভিজ্ঞতা এবং তার রচিত গ্রন্থগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ফারাবি সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সঙ্গীতের ওপরে তার দক্ষতা।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ফারাবি সঙ্গীতজ্ঞানে তাঁর সময়ের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক স্তরে পৌঁছেছিলেন, সঙ্গীত সম্পর্কিত তাঁর গ্রন্থই এর প্রমাণ। তাত্ত্বিক সঙ্গীতে ফারাবির দক্ষতা অর্জন সম্ভবত ব্যবহারিক সংগীতে তাঁর দক্ষতা অর্জনে অবদান রেখেছিল। বিশেষ করে তানপুরা ও বেহালার মতো কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজাতে ফারাবির দক্ষতা সম্পর্কে যা জানা যায় তাতে যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতার সত্যতার প্রমাণ মেলে। কিন্তু আরো বেশকিছু যন্ত্র বাজানোর ক্ষেত্রে তার দক্ষতা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত যে অদ্ভুত উপাখ্যানগুলো জানা যায় তা এখন গল্প ও কিংবদন্তির মতো হয়ে আছে এবং তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্য কারো কাছে নেই।

ফারাবি সম্পর্কে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার বর্ণনা করেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ সাইফুদ্দিন আমাদি যিনি সপ্তম শতাব্দীর একজন চিকিৎসক ও ইতিহাসবিদ ইবনে আবি আসিবার কাছে ফারাবি সম্পর্কে বর্ণনা করেছিলেন। ইবনে আবি আসিবা, ফারাবিকে দামেস্কের বাগান প্রহরী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন যে কিনা বাতির আলোয় রাত জেগে পড়ালেখা করেছেন। এ ছাড়া, ইবনে আবি আসিবা ফারাবী থেকে অনুরূপ একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন, ফারাবী তার প্রথম জীবনে একজন বিচারক ছিলেন। কিন্তু দর্শনের প্রতি ব্যাপক আগ্রহের কারণে যা কিনা ফারাবি দামেস্কের বাগানের প্রদীপের আলোয় বসে অধ্যয়ন করে অর্জন করেছিলেন, এরপর তিনি বিচারকের কাজ ত্যাগ করেছিলেন।

কিন্তু ফারাবি সম্পর্কে এসব গল্প কাহিনী প্রচলিত থাকলেও অনেক বিশেষজ্ঞ ফারাবির মতো এতোবড় দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর মর্যাদাকে অতি উচ্চে তুলে ধরার জন্য এ ধরনের ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হয়েছে মনে করেন।

আরেকটি অনির্ভরযোগ্য গল্প আছে যেটিকে কেউ কেউ ফারাবির হারান ভ্রমণ কাহিনী হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যদিও বাগদাদ, দামেস্ক ও হারানের মধ্যে খুব বেশি দূরত্ব নেই। এই বর্ণনার পেছনে বিশ্বাসযোগ্য নথিপত্রের অভাব রয়েছে। হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর একজন ইতিহাসবিদ মাসুদি তার আত-তানবিয়ে ওয়া আল-আশরাফ গ্রন্থে তৎকালীন শাসক মুতাওয়াক্কিলের সময় হাররানে দর্শনশাস্ত্র স্থানান্তর সংক্রান্ত আলোচনার অধ্যায়ে বাগদাদে ইওহানা বিন হাইলানের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু, ইবনে খালকানের বর্ণনার বিষয়বস্তু থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, তার মতে, ফারাবীর শিক্ষকতার সময় ইয়োহানা 'হারান' এলাকায় অবস্থান করছিলেন। সে কারণে ফারাবীও হারানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বাগদাদ থেকে হারানে গিয়েছিলেন এবং এরপর ইয়োহানা বিন হাইলানকে ব্যবহার করার জন্য ফারাবি ফের বাগদাদে ফিরে আসেন।

একইভাবে ফারাবীর মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত গল্পগুলোও খুব ঐতিহাসিক এবং সঠিক বলে মনে হয় না এবং এ গল্পগুলো কিংবদন্তির মতো হয়ে আছে যা প্রবীণদের মৌখিক বর্ণনায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ও প্রচলিত ছিল। দামেস্ক থেকে আশকেলনে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে দস্যুদের হাতে তার নিহত হওয়া সম্পর্কিত ঘটনা রয়েছে যা  নিয়ে অনেক গল্প ও কিংবদন্তি চালু রয়েছে। 

একটি বর্ণনায় ফারাবির দাফন অনুষ্ঠানে তৎকালীন শাসক সাইফুদ্দৌলা হামেদানির অংশগ্রহণ এবং দামেস্কের দক্ষিণে বাব আল-সাগিরের বাইরে তার দাফনের কথা বলা হয়েছে। আবার আরেকটি বর্ণনায় বাব আল-সাগিরে এবং অন্য বর্ণনায় শিয়া ইমামদের কবরের মধ্যে তাকে দাফন করার কথা বলা হয়েছে যেখানে ফারাবি ছাড়াও আরো অনেককে দাফন করা হয়েছে। ফারাবি কত সালে ইন্তেকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ আছে । যতদূর জানা যান তিনি ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন ।

অনেক গবেষক মনে করেন, যেহেতু ফারাবী ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ দার্শনিকের নিখুঁত উদাহরণ, তাই তার জীবনযাপন পদ্ধতি এবং আচরণ সম্পর্কে এমন কিছু বলা হয়েছে, যা আসলে সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, বলা হয়েছে যে তিনি তৎকালীন সাইফুদ্দৌলার মতো শাসকদের সেবার বিনিময়ে খুব কমই অর্থ গ্রহণ করতেন। তিনি পার্থিব সম্পদের কথা চিন্তা করেননি এবং নিজের পেশায় সন্তুষ্ট ছিলেন। এসব কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। 

সম্ভবত, এইসব কাহিনী বর্ণনাকারীরা ছিলেন এমনসব ব্যক্তিত্ব যারা সত্যিকারের দার্শনিককে এভাবেই কল্পনা করতেন এবং তাদের ভালোবাসতেন। কেননা ফারাবীর রচনা থেকে এ ধরনের কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না, যদিও তিনি যে সুফিবাদের পোশাক পরিহিত ছিলেন তা ছিল তাঁর কাজের কিছু অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এ ছাড়া, ফারাবীর সাথে সাহেব বিন এবাদের সাক্ষাত এবং বর্তমান ইরানের রেই শহরে তাঁর ভ্রমণের ঘটনাও এই মহান মনীষী সম্পর্কে বর্ণিত কিংবদন্তিগুলোর মধ্যে একটি। 

বায়হাকি 'আখলাক আল-হিকমা' নামক একটি অজানা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে রেই শহরে ফারাবি ও সাহেব ইবনে এবাদের মধ্যে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেছেন যা কাজভিনি দ্বারা বর্ণিত হয়েছে এবং পরবর্তী ‌আরো কিছু বর্ণনায় বিষয়টি পুনরাবৃত্তি হয়েছে কিন্তু এর সঠিক ভিত্তি নেই। এর প্রধান কারণ হল ফারাবীর মৃত্যুর সময় রুকনউদ্দৌলার প্রভাবশালী মন্ত্রী সাহেব ইবনে এবাদের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। অতএব, ফারাবী রেই শহরে সফরে গেলেও তার সাথে সাহেব ইবনে এবাদের এমন বৈঠক হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

‌আল ফারাবী সেইসব প্রতিভাবানদের মধ্যে একজন যাঁরা অত্যন্ত সংবেদনশীল ঐতিহাসিক মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর পরবর্তী চিন্তাবিদদের উপর গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বে ফারাবির প্রভাব এত বেশি যে, বলা যায় তার চিন্তাধারা ইসলামী সভ্যতা বিকাশের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এ কারণেই আবু নাসর ফারাবিকে "দ্বিতীয় শিক্ষক", "ইসলামী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা" এবং "ইসলামী বিশ্বে গ্রীক আনুষ্ঠানিক যুক্তির প্রেরণকারী" প্রভৃতি উপাধি দেওয়া হয়েছে।

ফারাবির প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন বা একীকরণ। তার বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক হিসাবে তার গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে অনেক ইতিহাসবিদ ও তাজকিরা লেখক তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দে-ফু এর মতো প্রাচ্যবিদরা তাকে ইবনে সিনার চাইতেও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ