জানুয়ারি ০২, ২০২৪ ১৫:৩৪ Asia/Dhaka
  • ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযানের ফলাফল-(পর্ব-৩)

পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ই অক্টোবর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিনে, গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা দখলদার ইসরাইলের অভ্যন্তরে সফল হামলা চালায় যা ইসরাইলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের ঘটনা। এ প্রসঙ্গে আমরা গত পর্বের আলোচনায় গাজা যুদ্ধের ফলে ইসরাইলের আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষতির নানা দিক নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকে আমরা গাজা যুদ্ধে হামাসের অর্জন সম্পর্কে কথা

দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলি অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া হিসাবে গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সামরিক অভিযান ফিলিস্তিনিদের জন্য কতটুকু লাভজনক হলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের রাজনীতির মূল কেন্দ্রে ফিলিস্তিন ইস্যুকে সবার সামনে ফিরিয়ে আনাই হামাসের প্রথম অর্জন বা সাফল্য বলা যয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দখলদার ইসরাইল এই অঞ্চলের মূল সমস্যা থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুটিকে লোকচক্ষুর আড়াল কেরার চেষ্টা করে আসছিল, কিন্তু আল-আকসা তুফান অভিযান তাদের সেই লক্ষ্য অর্জন বানচাল করে দিয়েছে। হামাসের সাফল্যের দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব সরকার ও জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি হওয়া, যাকিনা আরব অঞ্চলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সূচনা করতে পারে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ইসলামি জিহাদের সাথে কিছু আরব দেশের সরকারের বৈরী অবস্থান এবং প্রতিরোধ শক্তির সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আরব সরকারগুলো বিরত থাকলেও ফিলিস্তিন ইস্যু আরবসহ সমগ্র এ অঞ্চলের প্রধান বিষয় হিসাবে সামনে এসেছে।

হামাসের সাফল্যের তৃতীয় দিকটি হচ্ছে, আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে গেছে। সৌদি আরব দখলদার ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছিল এবং আলোচনা চলছিল। কিন্তু আল-আকসা তুফান অভিযানের পর তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই যে,  আল-আকসা তুফান অভিযান ইসরাইলের ভাবমূর্তি এবং এ অঞ্চলে তাদের অবস্থানকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যে ইসরাইলের গুপ্তচরবৃত্তির যন্ত্রপাতিগুলোর প্রতি আরব দেশগুলোর আস্থা বলতে গেলে উঠে গেছে। কারণ ইসরাইল যতই নিজেকে উন্নত অস্ত্রের অধিকারী এবং অপরাজেয় দাবি করুক না কেন ফিলিস্তিনিদের কাছে তাদের দুর্বলতা প্রমাণিত হয়েছে।

হামাসের সাফল্যের চতুর্থ দিকটি হচ্ছে, আল-আকসা তুফান অভিযান ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। টমাস ফ্রেডম্যান তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, '৭ অক্টোবরের পরের ইসরাইল আর আগের ইসরাইল নেই। ইসরাইল এখন এমন একটি অনিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে যেখানে এর অধিবাসীরা আগে কখনো বাস করেনি। এমন একটি জায়গা যার অধিবাসীদের রক্ষায় ইসরাইলি জেনারেলরা কাজ করেনি এবং আমেরিকার মতো মিত্রকে আগে কখনও সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।'

ইসরাইল গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ফলে এখন হামাস ধ্বংস হয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রকৃতপক্ষে, গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হামাস আন্দোলনকে পুরোপুরি ধ্বংস করা। আল-আকসা তুফান অভিযানের আগে, ইসরাইলি কর্মকর্তারা মনে করেছিল যে হামাস ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ থেকে সরে এসে আপোষ আলোচনার দিকে ঝুঁকে যাবে।

প্রকৃতপক্ষে, আল-আকসা তুফান অভিযান ছিল ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা কারণ এতে প্রমাণিত হয়েছে যে হামাসের ব্যাপারে তাদের ধারণা যে ভুল তাই নয় একই সাথে হামাস অন্তত এক বছর ধরে এ অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু ইসরাইল তাদের অভিযানের ব্যাপারে সামান্য আঁচও করতে পারেনি। যুদ্ধ শুরুর ৫০ দিনের মধ্যে, ইসরাইলি সেনারা হামাস যোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা অর্জিত হয়নি। মার্কিন বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিশনের প্রধান রিচার্ড হাশ বলেছেন, 'হামাসকে নির্মূল করা সম্ভব নয় বরং তারা আরও শক্তিশালী হতে পারে। কারণ হামাস শুধু একটি সেনাশক্তি নয়, হামাস একটি চিন্তাদর্শন যাকে শেষ করা যায় না।'

অন্যদিকে, তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালেস্টাইন স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মাইকেল মিলস্টেইনও মনে করেন, হামাসের সামরিক শাখায় ২৫ হাজারের বেশি সদস্য ছাড়াও, হামাসের সামাজিক অবকাঠামোতে ৮০ থেকে ৯০ হাজার  সদস্য রয়েছে।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযান শুরুর পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী দশকের পর দশক ধরে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। লোরেস্তানের শহীদদের কংগ্রেসের সদস্যদের সাথে এক বৈঠকে তিনি গাজার ভবিষ্যত পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে, আমেরিকাকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের সহযোগী বলে উল্লেখ করেছেন।  তিনি বলেছেন, 'এই অপরাধে আমেরিকার হাত কনুই পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের রক্তে ডুবে আছে। অর্থাৎ গাজায় এতোবড় হত্যাকাণ্ড ও  ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে মূল পরিচালকের ভূমিকায় রয়েছে আমেরিকা।'

বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষক, আইনজীবী ও কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরাইল জেনেশুনে এবং সজ্ঞানে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক সমাজের পক্ষ থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের প্রতি আমেরিকার সমর্থন। এ অবস্থায় মার্কিন সরকার কীভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করছে সেটাই এখন প্রশ্ন।

জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বৈধ প্রতিরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের কোনো সদস্য দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটলে, শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত আক্রান্ত দেশের জনগণের ব্যক্তিগত বা সামষ্টিকভাবে আত্মরক্ষার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ অবস্থায় আক্রান্ত দেশকে অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে তাদের আত্মরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানাতে হবে।

জাতিসংঘ সনদের এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মার্কিন সরকার দাবি করছে যে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। এ অজুহাতে তারা গাজার জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধ, অপরাধযজ্ঞ ও গণহত্যাকে আত্মরক্ষা হিসাবে দেখানের চেষ্টা করছে। প্রথম থেকেই মার্কিন সরকার ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে আসলেও তারা নিজেদেরকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করছে। অথচ তারাই যুদ্ধে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ