অমর কিংবদন্তি ওমর খৈয়াম-(পর্ব-৪)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা ওমর খৈয়ামের যুগের মক্তবখানা কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। এবারে আমরা বিরল প্রতিভার অধিকারী ওমর খৈয়ামের শৈশব ও তার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানবো।
ওমর খৈয়াম মাত্র দুই বছরে মক্তবের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন। এতো দ্রুত গতিতে তার শেখার এই প্রবণতা ছিল খুবই বিস্ময়কর। মৌলভী কাজী মোহাম্মদ বিরল ব্যক্তিত্ব ওমর খৈয়ামের প্রতিভায় বিস্মিত হয়ে খৈয়ামের পিতাকে পরামর্শ দেন যেন ছেলেকে 'খাজা আবুল হাসান আনবারীর' মক্তবখানায় পাঠানো হয়। খাজা আবুল হাসান আনবারী তখন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও গণিতবিদ হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যা তাঁর মক্তবখানায় প্রচলিত পদ্ধতিতে পড়ানো হত।
ওমর খৈয়াম তার নতুন শিক্ষক হাসান আনবারীর মক্তবখানায় যাওয়া শুরু করেন। ওমর খৈয়ামের প্রতিভা, দক্ষতা, উদার চিন্তা এবং বিচার-বিশ্লেষণের অসাধারণ ক্ষমতা সকলের কাছে সুপরিচিত ছিল। তাই তার আগমনের সাথে সাথে তিনি খাজা আবুল হাসান আনবারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। নতুন শিক্ষক ওমর খৈয়ামকে জ্যামিতি ও গণিতের মূল বিষয়গুলো শিখিয়েছিলেন। ওমর খৈয়াম, খাজা আবুল হাসান আনবারীর কাছে যাওয়ার পর, তার কাছ থেকে যতটা সম্ভব বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।
একদিন খাজা আনবারী তার ছাত্র ওমর খৈয়ামের পিতা ইব্রাহিমকে ডেকে বললেন, "আমি আপনার ছেলের চেহারায় অন্যান্য ছাত্রদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তা ও বিরল প্রতিভা দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি ওমর খৈয়ামকে শুধু আমার এই মক্তবখানায় পাঠানোই যথেষ্ট নয় বরং আরো উচ্চতর বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান, ইরফান, নীতিশাস্ত্র এবং সম্পূর্ণ কুরআনিক জ্ঞানে পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য 'ইমাম মোয়াফ্ফাক নিশাপুরী'র মক্তবখানায় পাঠানো উচিত যাতে তার শিক্ষাকে ওমর খৈয়াম কাজে লাগাতে পারে। এখানকার শিক্ষা শেষ করার পর ওমর খৈয়াম দর্শন অধ্যয়নের জন্য 'শেখ মোহাম্মদ মানসুর'-এর কাছে যেতে পারে।"
ওমর খৈয়ামের শিক্ষক খাজা আবুল হাসান আনবারীর এইসব পরামর্শ খৈয়ামের পিতা ইব্রাহিম সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি পুত্রের সুশিক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন এবং পরামর্শ মতো খৈয়ামকে ওইসব শিক্ষকের কাছে পাঠান।
এভাবে, ওমর খৈয়াম বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান, ইরফান বা আধ্যাত্মিকতা, নীতিশাস্ত্র এবং কুরআনিক বিজ্ঞান শেখার জন্য সেই সময়ের অন্যতম সেরা শিক্ষক, 'ইমাম মোয়াফ্ফাক নিশাপুরী'র কাছে যান, যা ছিল খৈয়ামের জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। তিনি এ মক্তবখানায় নজিরবিহীন প্রতিভার প্রমাণ দেন এবং অভাবনীয় উন্নতি করেন। সে সময় 'ইমাম মোয়াফ্ফাক নিশাপুরী' নিশাপুর শহরের অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি খাজা নিজাম আল-মুলক, হাসান সাবাহ এবং হাকিম ওমর খৈয়ামের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের শিক্ষক ছিলেন যারা কিনা পরবর্তীতে ইরানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
যাহোক, শিশু কিশোর অবস্থা পেরিয়ে ওমর খৈয়াম এখন খুবই ভদ্র, চিন্তাশীল এবং শান্ত প্রকৃতির তরুণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। শিক্ষক তাকে যা কিছু শেখাতেন তিনি খুব ভালোভাবে তা রপ্ত করতেন। ওমর খৈয়ামের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও আকর্ষণীয় বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনশাস্ত্রে আরো উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি ওস্তাদ মোহাম্মদ মানসুরের শরণাপন্ন হন।
এ পর্যন্ত আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, ওমর খৈয়াম খাজা আবুল হাসান আনবারীর মক্তব থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন এবং এরপর ইমাম মোয়াফফাক নিশাপুরীর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। সর্বশেষ দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য তিনি মোহাম্মদ মানসুরের সান্নিধ্যে আসেন। মোহাম্মদ মানসুর ছিলেন তার সময়ে দর্শনশাস্ত্রের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও শিক্ষক। তার প্রতি সবারই ব্যাপক উৎসাহ ও আগ্রহ কাজ করতো। দর্শনশাস্ত্রের এই শিক্ষকের কাছে ওমর খৈয়াম আরেক বিখ্যাত মনীষী ও দার্শনিক ইবনে সিনার লেখা বইপত্র এবং তার দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হন। ইবনে সিনার রচনাসামগ্রীতে ওমর খৈয়াম এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি ইবনে সিনার সমস্ত রচনা অধ্যয়ন শেষ করেন। এভাবে, তিনি ইবনে সিনার ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে এতোটাই দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল যে, অনেকের কাছে মনে হতো তিনি ইবনে সিনার সরাসরি ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, খৈয়ামের আগেই ইবনে সিনা ইন্তেকাল করেন। খৈয়ামের ওপর ইবনে সিনার চিন্তাভাবনার প্রভাব এতো ছিল যে, যেকেউ প্রশ্ন করতেন তারা দুজন কি একসাথে উঠাবসা করেছেন? কিংবা একজন আরেকজনের কাছে গেছেন?
অনেক চিন্তাবিদ ওমর খৈয়ামকে ইবনে সিনার উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত বলে মনে করতেন। খৈয়াম ছিলেন প্রাকৃতিক দর্শন এবং গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার পণ্ডিত। প্রাকৃতিক দর্শন ছিল মূলত প্রকৃতি তথা সমগ্র ভৌতবিশ্ব বিষয়ক অধ্যয়ন। আধুনিককালে যাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞান বলা হয় তা-ই একসময় ছিল প্রাকৃতিক দর্শন। প্রাকৃতিক দর্শনকে বলা যায় আধুনিক বিজ্ঞানের পূর্বসূরি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে শুরু করে অনেক বড় সকল বস্তুর গঠন এবং কার্যকারিতা নিয়ে জ্ঞানের এই শাখায় আলোচনা করা হতো।
যাইহোক, একপর্যায়ে ওমর খৈয়াম নিশাপুরের চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে আবির্ভূত হন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি চিন্তা গবেষণার এমন এক উচ্চস্তরে পৌঁছে যান যে ইমাম মোয়াফফাক নিশাপুরী, শেখ মোহাম্মদ মানসুরির মতো শিক্ষকরাও ওমর খৈয়ামের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সক্ষম হতেন না।
প্রকৃতপক্ষে, খৈয়াম বয়সে যত বড় হয়েছে, তত বেশি অধ্যয়ন করেছেন এবং যত বেশি অনুসন্ধান করেছেন, তত কম তিনি খুঁজে পেয়েছেন। তিনি কোনো একটি বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলে আরো অন্তত দশটি প্রশ্ন উত্থাপন করতেন। কিন্তু নিশাপুরের এই সীমিত পরিসরে তাঁর বহু জটিল প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়তো এবং তার জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটতো না। তাই আরো পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য তিনি সমরখন্দে যান।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।