ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪ ১৪:৩২ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বিরল প্রতিভার অধিকারী ওমর খৈয়ামের সমরখন্দ থেকে আফগানিস্তানের বালখে যাওয়ার পথে মজার কিছু অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজকেও আমরা এ সম্পর্কিত আলোচনা অব্যাহত রাখবো।

ওমর খৈয়াম বালখ পৌঁছার পর, তিনি সেখানে এক ব্যক্তির কাছে সংরক্ষিত বিখ্যাত গ্রীক গণিতবিদ 'অ্যাপোলোনিয়াস' এর জ্যামিতি বিষয়ক লেখা 'কোনস বা শঙ্কু' নামক বইয়ের মালিকের সাথে দেখা করেন। 'শঙ্কু' হচ্ছে, যেসকল ঘনবস্তুর ভূমিতল বৃত্তাকার ও সমতল এবং ভূমির ওপরের দিকের পৃষ্ঠতলের পরিধি ক্রমশ কমতে কমতে একটি বিন্দুতে পরিণত হয়েছে, জ্যামিতির পরিভাষায় তাদের কোনস্ বা শঙ্কু বলে। ওই ব্যক্তি জ্যামিতি বিষয়ক এ বইটি তিন দিনের জন্য খৈয়ামের কাছে রাখার অনুমতি দেন এবং ওমর এই স্বল্প সময়ের মধ্যে বইটির কপি লেখা সম্পন্ন করেন।

তিনি বালখ-এ কিছুকাল অবস্থান করার পর এবং সেখানকার নামকরা জ্ঞানগবেষণা কেন্দ্রের সাথে পরিচিত হওয়ার পর, খৈয়াম তার জ্ঞান সম্পূর্ণ করার জন্য ইরানের রেই শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নিশাপুর থেকে একজন বার্তাবাহক এসে তাকে খবর দেন যে তার বাবা খুবই অসুস্থ তাই তাকে নিশাপুরে যেতে হবে। খৈয়াম কালবিলম্ব না করে দ্রুত নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিশাপুরের দিকে রওয়ানা হন।

এদিকে, খৈয়ামের অসুস্থ পিতা ইব্রাহিম তার ছেলেকে দেখার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু খৈয়াম ছিলেন অত্যন্ত নরম এবং মানবিক আবেগে পরিপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারী। তিনি তার বাবার অসুস্থতার কথা শুনে দ্রুত নিশাপুর পৌঁছে যান। ওমর খৈয়াম যখন নিশাপুরে পৌঁছান তখনও পিতা ইব্রাহিম বেঁচে ছিলেন এবং পিতার জীবনের শেষ মুহূর্তে খৈয়াম তার পাশে থেকে তাকে শেষ বিদায় জানাতে সক্ষম হয়েছিল। পিতার মৃত্যু খৈয়ামের জন্য অনেক কষ্টকর ছিল।  পিতার মৃত্যুর পর খৈয়াম নিশাপুরেই থেকে যান এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি তার চিন্তা ও গবেষণা অব্যাহত রাখেন।

খৈয়াম নিশাপুরে ফিরে আসার পর যদিও তার জীবনে সচ্ছলতা ছিল না কিন্তু তিনি তার চিন্তা-গবেষণা ও সামাজিক সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি গবেষণা ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। খৈয়াম জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র এবং দর্শনে খুব আগ্রহী ছিলেন।

১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে, নিশাপুর শহরে ওমর খৈয়াম গণিত বিষয়ক 'রাসালেহ ফি শারহ মা আশকেল মান মোসাদেরাতে ইউক্লিড' নামে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন, যেখানে তিনি সমান্তরাল রেখা এবং অনুপাতের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই বইটি তৎকালীন সময়ের প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় আরবিতে লেখা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে আমরা এই গ্রন্থটিসহ হাকিম ওমর খৈয়ামের অন্যান্য গ্রন্থের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় খৈয়ামের সাফল্যের নানাদিক নিয়ে কথা হবে।

ওমর খৈয়ামের গণিত বিষয়ক 'রাসালেহ ফি শারহ মা আশকেল মান মোসাদেরাতে ইউক্লিড' গ্রন্থ

ওমর খৈয়াম ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে কখনো ক্লান্ত হতেন না। ধীরে ধীরে তিনি ইরানসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলে একজন বিজ্ঞানী ও পণ্ডিত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর খ্যাতি ইরানের তৎকালীন শাসক সেলজুকদের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অবশ্য এর আগে থেকেই তিনি সেলজুক দরবারে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন এবং সেলজুক দরবারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন "নিজাম উল-মুলক" নামে একজন ব্যক্তি যিনি খৈয়ামকে ভালোভাবে চিনতেন এবং তার সাথে তার পুরনো বন্ধুত্ব ছিল।

নিজাম উল-মুলক সবসময় ওমর খৈয়ামের জ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন। কয়েকটি সূত্রে বলা হয়েছে যে, খৈয়াম "নিজাম উল-মুলক" এর সন্তানদেরও শিক্ষা দিতেন এবং 'নিজাম উল-মুলক' খৈয়ামকে তার শিক্ষার পুরস্কার হিসেবে নিশাপুরে একটি বাগানও দিয়েছিলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, খৈয়ামের মৃত্যুর  পর তাঁকে ওই বাগানেই দাফন করা হয়েছিল। যেহেতু নিজাম উল-মুলক ছিলেন খৈয়ামের জীবনে প্রভাব সৃষ্টিকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, তাই চলুন আমরা আলোচনার এ পর্যায়ে নিজাম উল-মুলকের সাথে খানিকটা পরিচিত হই।

"আবুল হাসান আলী বিন ইসহাক বিন আব্বাস তুসী" যিনি "খাজা নিজাম উল-মুলক তুসী" নামে পরিচিত। তিনি হিজরী ৫ম শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা ইরানী বিজ্ঞানী ও লেখক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। একইসাথে তিনি ছিলেন সেলজুক শাসনামলের একজন নামকরা মন্ত্রী। "নিজাম উল-মুলক" ছিলেন সাবজেভার এলাকার এক কৃষকের পুত্র। তিনি ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে মাশহাদ শহরের নিকটবর্তী 'তুস' শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

সেই সময়ে এবং তারও আগে বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৃষকরা জমির মালিক ছিলেন না। কিন্তু গ্রামের যারা জমির মালিক তারা অভিজাত শ্রেণী বলে বিবেচিত হতেন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা ছিলেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান।

যাইহোক, কৃষকপুত্র "খাজা নিজাম উল-মুলক তুসী" তুস শহরে বড় হয়েছিলেন এবং সেখানেই পড়াশোনা করেছিলেন। সে কারণেই তিনি "খাজা নিজাম উল-মুলক তুসি" নামে পরিচিত হন।  তাঁর বয়স যখন ২১ বছর, তখন তিনি গাজনে যান এবং অলেব আরসালান সেলজুকির মন্ত্রী আবু আলী ইবনে শাজানের সান্নিধ্যে আসেন। দরবারে তিনি একজন লেখক হিসাবে নিয়োজিত হন। অলেব আরসালান সেলজুকি মাত্র ৩২ বছর বয়সে "নিজাম উল-মুলক" এর অসাধারণ প্রতিভা প্রত্যক্ষ করে খ্রিস্টিয় ১০৬৪ সালে নিজামকে তার মন্ত্রী হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন এবং তাকে দেশের সমস্ত বিষয়ের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সেই সময় থেকে ২৯ বছর পর পর্যন্ত, নিজাম উল-মুলক সেলজুক দরবারের মন্ত্রী ছিলেন এবং প্রশাসনিক সুবিধা নিয়ে ইরানীদের জন্য অনেক সেবামূলক কাজ করেছেন তিনি। 

রাজার কনিষ্ঠ পুত্র অলেপ আর্সালানের মৃত্যুর পর, 'নিজাম উল-মুলক' মালেক শাহ সেলজুককে সিংহাসনে বসাতে সহায়তা করেন, যার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। সে সময় ইরানে বিশৃঙ্খলা ও বিভিন্ন ধরনের সংকট ছড়িয়ে পড়েছিল এবং নিজাম উল-মুলক পরিস্থিতির উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি অল্পবয়সী রাজা মালিক শাহকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে তাকে একজন শক্তিশালী শাসকে পরিণত করেছিলেন। 'খাজা নিজাম উল-মুলক তুসি' ইরানের জনগণের প্রতি প্রবল ভালোবাসার কারণে তিনি দেশের উন্নয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন এবং সাধ্যমতো চেষ্টা চালাতেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ