মার্চ ০৩, ২০২৪ ২১:১২ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে বালখ থেকে খৈয়ামের নিশাপুরে প্রত্যাবর্তন এবং তার গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ও তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তি নিজাম উল-মুলক এর জীবনের নানা দিক ও তার অবদান নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকেও আমরা এ সম্পর্কিত আলোচনা অব্যাহত রাখবো

নিজাম উল-মুলক ছিলেন সেলজুক রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। একসময় ইরানে বিশৃঙ্খলা ও বিভিন্ন ধরনের সংকট ছড়িয়ে পড়লে তিনি পরিস্থিতির উন্নতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। মানুষকে জ্ঞানার্জনের দিকে উৎসাহিত করতেন। এ কারণে তিনি ইরানে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শিক্ষাকেন্দ্র বা  বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মধ্যে একটি ছিল "নিজামিয়া" বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ যা সেই সময়ের বড় বড় শহরগুলো যেমন নিশাপুর, বাগদাদ, কায়রো, ইস্ফাহান, অমোল, বালখ ও হেরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইরানের এই মন্ত্রীর নামে নামকরণ করা 'নিজামি স্কুল' প্রতিষ্ঠা ছিল ইসলামিক স্কুল বা শিক্ষাকেন্দ্রের পরিধি সম্প্রসারণের এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের সূচনা। কেননা এরপর অনেক রাজনৈতিক নেতা ও জ্ঞানীব্যক্তি খাজা নিজাম ‌উল-মুলকের শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করে এই ধরণের আরো শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ৫ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ৭ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মঙ্গোলদের আক্রমণের সময় পর্যন্ত, মুসলিম বিশ্বে  জ্ঞানবিজ্ঞানের ইতিহাসে এসব শিক্ষাকেন্দ্রগুলো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।

নিজাম উল-মুলকের ভাস্কার্য

'নিজামি স্কুল বা শিক্ষাকেন্দ্রের' শিক্ষক, পরিচালক এবং কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হতো। এছাড়াও, এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর বিশেষ নিয়মকানুন ছিল এবং শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করা হতো। এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে উঁচুস্তরে শিক্ষক পদে পৌঁছানোর জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা হতো। এককথায় বলা যায় আধুনিকতার শীর্ষে ছিল এসব শিক্ষাকেন্দ্রগুলো।

প্রকৃতপক্ষে, নিজাম উল-মুলকের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সেলজুকদের অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নতি এবং তাদের শাসনাধীন অঞ্চলের উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। তার মন্ত্রিত্বকালে জনগণের কাছ থেকে বিশেষ কর আদায়ের বিনিময়ে একের পর এক শহরের রাস্তাঘাট ও ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। খাজা নিজাম উল-মুলক তুসি মন্ত্রিত্ব ও রাজনৈতিক বিষয়ে দক্ষতা ছাড়াও লেখালেখিতেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ইরানের পূর্ববর্তী রাজাদের শাসনকৌশল, রাষ্ট্রব্যবস্থা, নীতিশাস্ত্র এবং রাজনীতি বিষয়ক একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম "সিয়াসাত নামা" বা "সির আল-মুলক" এবং এটি ১১ খ্রিস্টাব্দে ফার্সি ভাষায় রচিত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বইগুলোর মধ্যে একটি।

নিজাম উল-মুলকের অবদান ও সেবামূলক কাজ নিয়ে বলার মতো অনেক কথা আছে। সেলজুকদের রাজধানী নিশাপুর থেকে ইস্ফাহানে স্থানান্তরের পর, সেখানেও তিনি অবকাঠামো উন্নয়নে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তার নামকরা কিছু পদক্ষেপের মধ্যে ইস্ফাহানে মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র 'মানমন্দির' নির্মাণ ছিল অন্যতম। নিজাম উল-মুলক সেলজুক রাজা "মালেকশাহ"-এর অনুমতি নিয়ে ওমর খৈয়ামকে এই শহরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এই মানমন্দির স্থাপনে সাহায্য করার এবং জ্যোতির্বিদ্যা বোর্ডের প্রধান হওয়ার জন্য খৈয়ামকে অনুরোধ করেন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ওমর খৈয়াম  নিশাপুর থেকে ইস্ফাহানে যান এবং ১৮ বছর এই শহরে অবস্থান করেন।

ইস্পাহানে সেলুজক যুগের স্থাপনা

ইস্ফাহান শহরটি বর্তমান ইরানের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত। সেলজুক আমলে এই রাজবংশের শাসকরা এই শহরের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন এবং এই শহরের উন্নয়নে তারা অনেক অর্থ ব্যয় করেছিলেন। কথিত আছে যে, তোঘরোল এবং তার উত্তরসূরিদের সময়, ইস্ফাহান শহরের উন্নয়ন এবং এর চারপাশে মসজিদ ও সুউচ্চ ইমারত নির্মাণে প্রায় পাঁচ লাখ দিনার ব্যয় করা হয়েছিল।

ইবনে জোজির লেখা অনুসারে, রাজ দরবারের কোষাগারের সাথে এই খরচের পরিমাণ তুলনা করে দেখা গেছে, বাদশা মালেক শাহ মারা যাওয়ার সময় মাত্র বিশ হাজার দিনার ও স্বর্ণমুদ্রা রেখে গিয়েছিলেন। নাসের খোসরু নামে একজন ইরানী পর্যটক যিনি এক হাজার বছর আগে সেলজুক রাজা তোঘরোলের শাসনামলে ইস্ফাহান ভ্রমণ করেছিলেন তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীতে ইস্ফাহানের জনগণের কল্যাণময় জীবন ও নানান সুযোগ সুবিধার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, সেলজুক রাজা তোঘরোল নিশাপুরের একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে শহরের শাসনভার অর্পণ করেন, যার নাম ছিল 'খাজা উমিদ'। এ সম্পর্কে ওই ইরানি পর্যটক তার ভ্রমণকাহিনীতে আরো বলেছেন, "...সুলতান নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তারা তিন বছর পর্যন্ত জনগণের কাছে কিছুই চাইবে না... কারণ আমরা এখানে আসার আগে, এখানকার জনগণ বিশাল দুর্ভিক্ষে পতিত হয়েছিল।

আমরা যেমনটি বলছিলাম যে সেলজুকরা ইস্ফাহান শহরের উন্নতি ও বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিল এবং বহু সুন্দর ভবন নির্মাণ করেছিল। তবে একইসাথে, সেলজুকদের ওই উন্নয়ন প্রচেষ্টার পেছনে স্থানীয় ইরানি কারুকার্য শিল্পেরও বিরাট ভূমিকা  ছিল।  যদিও সেলজুকরা শিল্পের প্রতি খুব একটা অনুরাগী ছিলেন না কিন্তু  ইরানি শিল্পীদের অবদানের কারণে আমরা দেখতে পাই যে ইরানের সেলজুক আমলের স্থাপনাগুলোতে ইরানের প্রাচীন স্থাপনার ছাপ রয়েছে।

এসব স্থাপনা নির্মাণে ইট এবং দেয়ালে প্লাস্টারের কাজে জিপসাম ব্যবহার করা হতো। একইসাথে ভবনজুড়ে ভেতরে ও বাইরে আঁকা হতো দৃষ্টিনন্দন নকশা। চোখ ধাঁধানো এসব স্থাপনা নির্মাণপদ্ধতি সাসানিয় যুগ থেকে শুরু করে সেলজুক শাসনামল পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। ওই সময়গুলোতে ইসলামি স্থাপনা ও ভাবধারার সাথে ইরানি স্থাপনার মিশ্রণ ঘটে। ইরানি পর্যটক নাসের খোসরু তার ভ্রমণকাহিনীতে ইস্ফাহান শহরের নজরকাড়া সুন্দর সুন্দর ভবনের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন "হামুন নদীর তীর ঘেঁষে ইস্ফাহান শহর গড়ে উঠেছে যেখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। প্রতি ১০ গজ পরপর কূপ খনন করলে সেখান থেকে বের হয়ে আসে ঠাণ্ডা মিষ্টি পানি। শহরের চারদিকে সুন্দর প্রাচীর রয়েছে। সেখানে অনেকগুলো প্রবেশপথ এবং শত্রুর মোকাবেলায় যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য রয়েছে বিশেষ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও দুর্গসমূহ। শহরের মাঝখানে আছে অনেক বড় আদিনা মসজিদ। শহরের চারদিকের প্রাচীরের দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন 'ফারসাঙ্গ'। অর্থাৎ বর্তমান হিসাবে ২১৮৪ কিলোমিটার লম্বা। শহরের ভেতরটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি নগরী এবং কোথাও ধ্বংসের চিহ্ন দেখিনি। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ