রংধনু আসর
রূপকথার গল্প: জঙ্গলের শাহানশাহ
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। রংধনুর আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকবে একটি রূপকথার গল্প। গল্পটি লিখেছেন বাংলাদেশি সাহিত্যিক, গল্পকার, গবেষক ও কবি আশরাফ সিদ্দিকী। গল্পের পর থাকবে একটি আবৃত্তি। আর সবশেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করছি আমাদের আজকের গল্প 'জঙ্গলের শাহানশাহ'।
একবার এক গ্রাম থেকে ছুটে বেরিয়ে এল এক বিড়াল। আর পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল খেঁকশিয়ালদের এক যুবতী কন্যা। পথের ওপরেই ওদের দেখা হয়ে গেল। শিয়ালী বিড়ালের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি তো অনেক দিন থেকেই এই জঙ্গলে বাস করি। কিন্তু তোমার মত কোনো জন্তু আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না! কে তুমি? নাদুস-নুদুস স্বাস্থ্যের চালাক-চতুর বিড়ালরটি দৃঢ়তা ও দাপটের সাথে উত্তর দিল, আমি হলাম এই জঙ্গলে শাহানশাহ! শিয়ালী জানতে চাইলো, শাহানশাহ! সে আবার কেমন জন্তু?
বিড়াল চট করে উত্তর দিল, আমি হলাম সমগ্র জঙ্গলের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী! যা কিছু আমার সামনে পাই, আমার ইচ্ছে হলেই তা আমি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলি। শিয়ালী প্রমাদ গুনলো এবং বললো, বেশ, ভালো কথা। তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে কর। সম্পদ হিসাবে আমার একটি সুন্দর বাড়ি আর একটি মনোরম বাগান আছে।
বিড়াল রাজি হলো এবং শিয়ালীর সাথে তার বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করলো। সপ্তাহ কাটে মাস কাটে কিন্তু বিড়াল কখনো শিয়ালীর বাড়ির বাইরে যায় না। শিয়ালী যা কিছু শিকার করে আনে তাই খেয়ে বড্ড আরাম-আয়েশে বিড়ালের দিন কাটে।
একদিন খরগোশের সাথে শিয়ালীর পথে দেখা হল। খরগোশ বললো, এই যে ছোটবোন, আমি তো বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই তোমার বাড়িতে যাচ্ছিলাম। শিয়ালী বললো, এখন আমার বাড়িতে থাকেন জঙ্গলের শাহানশাহ। উনি তো তোমাকে পেলে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে!
এ কথা শুনে খরগোশ খুব ভয় পেয়ে গেল এবং ফিরে গিয়ে সে নেকড়ে ভালুক আর বন্য শুয়োরের কাছে জঙ্গলের শাহানশাহর গল্প শুনালো। ওরা সবাই একত্রিত হয়ে বুদ্ধি আঁটতে লাগলো- কিভাবে জঙ্গলের শাহানশাহকে একবার দেখা যায়।
অবশেষে ওরা সিদ্ধান্ত নিল যে ওরা একটা ভোজের ব্যবস্থা করবে এবং তাতে শিয়ালী ও তার জঙ্গলের শাহানশাহকে দাওয়াত দেবে। এবার ওরা ভোজের জন্য কে কী করবে সেটা স্থির করতে লাগলো।
নেকড়ে বললো, আমি গোশতের ব্যবস্থা করবো। বন্য শুয়োর বললো, আমি আলু এবং বাদাম নিয়ে আসবো। ভালুক ভাবলো, আমি কিছু মধুর ব্যবস্থা করবো, যাতে করে ভোজের শুরুতে খাওয়া যায়। খরগোশ বললো, আমার দায়িত্বে তাহলে বাঁধা কপিটাই থাকে। ওটার ব্যবস্থা আমি করে নেব।
ঠিক সময় মতো ওরা যে যার জিনিসপত্র নিয়ে এলো এবং রান্না শুরু করে দিল। খাবার প্রস্তুত হওয়ার পর ওরা চিন্তা করতে শুরু করলো কে যাবে জঙ্গলের শাহানশাহকে দাওয়াত দিতে।
ভালুক বললো, আমি তো খুব জোরে দৌড়াতে পারি না। সে যদি আবার আমাকে তাড়া করতে আসে! বন্য শুয়োর বললো, আমিও তো চলাফেলায় অত দ্রুত নই। নেকড়েও বললো, আমি তো বুড়োই হয়ে গেছি! তার ওপর চোখেও কম দেখতে পাই।
শেষমেষ দেখা গেল একমাত্র খারগোশই এই কাজের যোগ্য! এবার খরগোশ ছুটলো শেয়ালীর গুহার উদ্দেশ্যে তাদেরকে দাওয়াত দিতে। এক সময় বাসার ভেতর থেকে শেয়ালী লক্ষ্য করলো, তার বাসার বাইরে একটু নিরাপদ দূরত্বেই খরগোশ একা দাঁড়িয়ে আছে।
সে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী জন্যে এসেছ ভাই? খরগোশ বললো, বনের নেকড়ে ভালুক আর বুনো শুয়োর, আর হ্যাঁ আমিও আছি, আমরা সবাই মিলে তোমাকে ও তোমার জঙ্গলের শাহানশাহকে আমাদের ভোজে দাওয়াত দিচ্ছি।
শেয়ালী বললো, ঠিক আছে, জঙ্গলের শাহানশাহকে নিয়ে আমি আসবো। কিন্তু অবশ্যই তোমরা সবাই লুকিয়ে থেকো! তা নইলে উনি আবার তোমাদের সবাইকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
খরগোশ তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে সবার কাছে ঘোষণা করলো, লুকাও! লুকাও! কারণ শিয়ালী বলেছে জঙ্গলের শাহানশাহ এলে সে আমাদের সবাইকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
ভালুক জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি ওদেরকে নিজেদের চামচ নিয়ে আসতে বলেছো? হায়রে কপাল!
খরগোশ বললো, আমি তো এ কথা বলতে ভুলেই গেছি! খরগোশ আবার ছুটলো। সে কোনোমতে লুকিয়ে শেয়ালীর ঘরের কাছে পৌঁছে চিৎকার করে বললো, চামচ নিয়ে এসো কিন্তু! তারপর তিন লাফে সরে এসে পালাতে শুরু করলো।
খরগোশ ফিরে এসে দেখলো অন্য পশুরা এরমধ্যেই লুকাতে শুরু করেছে। বন্য শুয়োর লুকিয়েছে টেবিলের নিচে, কিন্তু তার লেজের আগাটা বেরিয়ে আছে। ভালুক গিয়ে উঠেছে পাশের জাম গাছটার ওপর আর নেকড়ে ও খরগোশ লুকালো আর একটি গাছের টুকরো করা গুড়ির আড়ালে।
শেয়ালী এলো, আর তার পিছে পিছে এলো জঙ্গলের শাহানশাহ। তারা সরাসরি খাবার টেবিলের কাছেই পৌঁছে গেল। স্তুপ করা খাবার দেখে বিড়াল এক লাফে টেবিলের ওপর উঠে বসলো আর হাপুস হুপুস করে খেতে শুরু করলো।
খাওয়ার সময় অভ্যাসবশত বিড়ালের গলা দিয়ে যে গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছিল তা শুনে অন্য পশুরা মনে করলো সে বুঝি আরও বেশি খাবারের জন্য রাগ দেখাচ্ছে। ওরা ভাবলো এই পশুটা এত ছোট অথচ আমাদের চারজনের খাবার সে একাই সাবাড় করে দিচ্ছে। তার ওপর আবার আরও খাবারের জন্য রাগ দেখাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড!
এদিকে বিড়ালের পেট যখন ভর্তি হয়ে গেল, সে তখন টেবিলে ওপরেই তার পা টান করে শুয়ে পড়লো। অন্যদিকে কোত্থেকে এসে একটি মশা বন্য শুয়োরকে বিরক্ত করছিল বলে সে তার লেজটাকে সামান্য নাড়ালো। লেজের শুধুমাত্র আগাটুকুকে নড়তে দেখে বিড়াল ভাবলো, এটা বুঝি একটি ধেঁড়ে ইঁদুর। সে এক লাফে টেবিলের ধারে পৌঁছে একটি থাবা বসিয়ে দিল বন্য শুয়োরের লেজে।
বন্য শুয়োর ভাবলো, এবার বুঝি জঙ্গলের শাহানশাহ তাকেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খেতে চায়। সে ভয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে জাম গাছের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পুরো গাছটাই এতে কেঁপে উঠল। আর এদিকে বিড়াল ভয় পেয়ে এক লাফে জাম গাছের ওপর উঠে গেল।
ওখানে লুকিয়ে ছিলো ভাল্লুক। সে ভাবলো, এবার বুঝি আমাকেই খেতে চায় জঙ্গলের শাহানশাহ! ভারী শরীর নিয়ে লাফ দিতে গিয়ে কাঠের গুঁড়ির ওপর আছড়ে পড়লো সে। এরই আড়ালে লুকিয়ে ছিল নেকড়ে ও খরগোশ। ওরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিলো ভোঁ দৌড়।
মুহূর্তেই ঘটে গেল এত বড় কাণ্ড! অনেকক্ষণ পর ওরা সবাই এক জায়গায় একত্রিত হলো, শুধু খরগোশকে খুঁজে পাওয়া গেল না! সে যে কোথায় উধাও হয়ে গেছে তা কেবল আল্লাহই ভালো জানেন।
বন্য শুয়োর বললো, আমি তো একটুর জন্য বেঁচে গেছি। সেতো আমার লেজ ধরে আমাকে ওক গাছের ওপর ছুড়েই মেরেছিল বলতে গেলে! ভালুক বললো, সে তো আমার লোম ধরে টান দিয়ে আমাকে গাছ থেকে ফেলেই দিয়েছিল! নেকড়ে বললো, আমি তো কাঠের গুঁড়ির নিচে লুকিয়ে ছিলাম। সে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে আঘাত করলো! সে জন্যেই তো আমার পিঠে এখন ভয়ানক ব্যথা!
এদিকে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বিড়ালটা জাম গাছের ওপর বসেই রইলো। শিয়ালী এসে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাকে গাছ থেকে নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেল।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি আবৃত্তি। রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতাটি আবৃত্তি করেছে ছোট্টবন্ধু আবদুল্লাহ খান শায়ন।
শায়নের চমৎকার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। বন্ধুরা, এবার শুনবে একটি প্রেরণামূলক গান। 'আলোর পাখি' শিরোনামের গানটির কথা লিখেছেন কবি জাকির আবু জাফর, সুর করেছেন লিটন হাফিজ চৌধুরী আর গেয়েছে শিশুশিল্পী রাফা, মাহজুবা, মুহতাহিনা, মাফরুহা, সাওদা, রাবেয়া, আফিয়া, নুসরাত, তাশফিয়া এবং আরও অনেকে।
একঝাঁক ছোটবন্ধুর কণ্ঠে গানটি শুনলে। আশা করি ভালো লেগেছে। তো বন্ধুরা, দেখতে দেখতে আমাদের আজকের আসরের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এলো। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে। সে পর্যন্ত তোমরা সবাই ভালো ও সুস্থ থেকো।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।