আগামীকালের প্রশান্তি আজকের পরিশ্রমেরই সুফল
সোনালী সময়-১৪ (ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার গুরুত্ব)
ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া না ভাবিও- এটি এমন একটি প্রবাদবাক্য যা সব বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য হলেও যুব সমাজের জন্য রয়েছে এর বিশেষ গুরুত্ব।
আবেগ বা খেয়ালিপনার বশবর্তী হয়ে যারা কোনো কাজ করেন তারা কখনও জীবনে তাদের মত সফল হতে পারে না যারা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে একের পর এক উন্নতির শীর্ষ-পর্যায় বা সোপানগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হন। পরিবারের যে সন্তান এখনও প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি সে যদি তার সিনিয়র ব্যক্তি কিংবা মুরুব্বি অথবা ভাই বা বোনদের অভিজ্ঞতা ও জীবন থেকে শিক্ষা নেয় তথা বড় ভাই ও বোনদের সাফল্য আর ব্যর্থতাগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয় তাহলে সে একই ধরনের ভুল করবে না, অন্যদিকে তিনি সিনিয়রদের সাফল্যের চেয়েও বড় সব সাফল্য অর্জন করতে পারেন একই ধরনের পরিকল্পনার সঙ্গে নিজের মেধা, উন্নত চিন্তা ও দক্ষতার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যম। যুব সমাজ তাদের বুদ্ধিমত্তা, মেধা ও দৃঢ় ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে যত বেশি সক্রিয় হবে ততই তাদের পরিকল্পনা হবে বেশি নিখুঁত এবং ভবিষ্যতের চিন্তা বা আশা তাদেরকে যোগাবে বাড়তি অনুপ্রেরণা ও অবিচল আস্থা। এ অবস্থায় সংকট বা বাধাগুলো অতিক্রম করাও তার জন্য হয়ে পড়বে সহজ।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) খন্দকের যুদ্ধের সময় তাঁর দূরদর্শিতার মাধ্যমে বা খোদা-প্রদত্ত ভবিষ্যৎ জ্ঞানের সুবাদে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে মুসলমানরা একদিন বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হবে এবং রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য তাদের পদানত হবে। সে সময় অনেকেই তা বিশ্বাস করেনি এবং মুনাফিক শ্রেণীর অনেকেই হয়তো ভাবছিল যে মুসলমানরা দরিদ্র ও অভুক্ত থেকে কাজ করছে তারা এত বড় স্বপ্ন দেখে কোন্ আক্কেলে? কিন্তু সত্যিই মহানবীর ওফাতের পর প্রায় বিশ বছরের মধ্যেই পারস্য সাম্রাজ্য ও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য মুসলমানদের দখলে চলে আসে। মহানবী (সা) ইসলাম প্রচার শুরু করেছিলেন মাত্র দুজনকে নিয়ে। সেই প্রথম দুই মুসলমান ছিলেন হযরত খাদিজা ও আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী। বর্তমানে মুসলমানরা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাতি। বিশ্বের প্রায় দুইশ কোটি মুসলমান যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে তাদের অর্থ, মেধা ও নানা ধরনের শক্তি আর যোগ্যতাকে কাজে লাগায় তাহলে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ সব ধরনের উন্নতির জোয়ার বইয়ে দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু হবে না।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে আজকের ইরানি যুব সমাজের যে অগ্রগতি তাও কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতারই সুফল। একটি জাতির যুব সমাজ যদি নানা বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ পায় ও বিশ্বের নানা দেশ সফরের মাধ্যমে উন্নত নানা প্রযুক্তি এবং কৌশল শিখতে পারে তাহলে সেই জাতির অগ্রগতি মাত্রা বহু গুণে যে বেড়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে জন্য বিদেশে গিয়ে কেবল ব্যক্তি স্বার্থের কথা চিন্তা করে সেই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে থেকে যাওয়ার মানসিকতাই যেন গুরুত্ব না পায়। দেশ তাকে যে সেবা দিয়েছে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশুনার সুযোগ দিতে যে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে তার প্রতিদানে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেশের উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য যথাসাধ্য কাজ করার মানসিকতাও তাদের মধ্যে থাকা উচিত।
জাতীয় সম্পদ ও পারিবারিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দূরদর্শিতা ও পরিকল্পনা থাকা জরুরি। জাতীয় বাজেট পরিকল্পনার মতই তা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যারা মধ্যপন্থা বা ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করবে না তারা শিগগিরই সংকটের শিকার হয়। যেমনটি কবিতায় বলা হয়েছে: যেজন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি আশু গৃহে তার জ্বলিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি। অপব্যয় ও বিলাসিতা মানুষের জন্য অভাব বয়ে আনে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়াতে যে আয়ু দিয়েছেন তা সর্বোচ্চ মাত্রায় এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে পরকালের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বরং পরকালে এর সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যায়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি তারাই যারা দুনিয়ার অস্থায়ী জীবনের সুখের জন্য পরকালের চিরস্থায়ী জীবনকে বিপদাপন্ন করেন না। আত্মসংশোধেনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যারা যৌবনকালে নিজেদের সংশোধন করতে পারে না পরবর্তীকালে নিজেদের সংশোধন করা তাদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির মতে একটি দেশের ছাত্র ও যুব সমাজকে শিক্ষায়, চিন্তা-চেতনায়, ধার্মিকতায়, নৈতিকতায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে যত বেশি উন্নত আর দক্ষ করা সম্ভব হবে সেই দেশ বা জাতি তত বেশি সুফল ভোগ করবে ভবিষ্যতে। কারণ যুব সমাজই একটি জাতির প্রকৃত ভবিষ্যৎ। তারাই দেশের বিভিন্ন বিভাগে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবেন। সমাজ ও জাতির যুগোপযোগী চাহিদাগুলো মেটাতে হলেও একটি জাতি যুব সমাজের মুখাপেক্ষী।মরহুম ইমাম খোমেনী যখন ছাত্র জীবনে পড়াশুনা করতেন তখন কি তিনি জানতেন যে একদিন তিনি হবেন একটি জাতির অবিসম্বাদিত নেতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা? তিনি নিজের গোটা জীবনকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন পূর্ব-পরিকল্পনার আলোকে। তাঁর জীবন ছিল পরিকল্পনা ও নিয়মানুবর্তিতায় ভরপুর। ছাত্র জীবনেই যারা তাঁকে চিনতেন তারা ইমামের চলাফেরা দেখে বুঝতে পারতেন যে এখন ঘড়িতে এতটা বেজেছে, কারণ খোমেনি এখন অমুক স্থান দিয়ে মাদ্রাসার দিকে যাচ্ছেন বা মাদ্রাসা থেকে বের হয়েছেন!
একটি বৃক্ষ একদিনেই মহীরুহে পরিণত হয় না। ধীরে ধীরে পরিচর্যা করে গাছকে বড় করে তুলতে হয়। বলা হয় ছোটো ছোটো বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল! ছোটো ছোটো প্রকল্প বা পরিকল্পনায় সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে বৃহত্তর পরিকল্পনায় সাফল্য অর্জনের দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হয় এভাবেই। যারা ব্যবসা বাণিজ্যে বা অর্থনৈতিক খাতে রাতারাতি ধনী হতে চায় তারা আসলে সেই লিকলিকে বা চিকন গাছের মতই বেড়ে ওঠে এবং ঝড়ের প্রথম ধাক্কাতেই সেই গাছ উপড়ে পড়ে। মনে রাখবেন আজকের দিনটি আগামীকাল হয়ে পড়বে গতকাল। আর আগামীকালের দিনটিও বর্তমান হয়ে ভবিষ্যৎকালের তালিকা থেকে বাদ পড়বে। আগামীকালের প্রশান্তি আজকের পরিশ্রমেরই সুফল। তাই যথাযথ পদক্ষেপ ও নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যতকে সুখময় ও সৌভাগ্যময় করতে হবে। যে আজ মহাজ্ঞানী বা উচ্চ শিক্ষিত তাকেও ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক স্কুলসহ নানা পর্যায় অতিক্রম করে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে।
যার পূর্বপরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টি যত বেশি প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল সে তত বেশি সৌভাগ্যের ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। যেসব দেশ দক্ষ ক্রীড়াবিদ বা ফুটবলার বা ক্রিকেটার জন্ম দিয়েছে তারা এইসব দক্ষ ক্রীড়াবিদকে সাধারণ শৈশব থেকেই নানা সুযোগ-সুবিধা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন হলে তারা কখনও তারকা খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হতেন না।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।