ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪ ১৫:০১ Asia/Dhaka
  • 'খোরাসানি দায়েশ' মার্কিন সন্ত্রাসবাদের প্রধান হাতিয়ার (পর্ব-১)

উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। খুবই উগ্র ও হিংস্র এই গোষ্ঠীটি ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কিছু পরাজিত সন্ত্রাসী গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল যারা পরবর্তীতে আমেরিকার সাহায্য সমর্থনে আফগানিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।

আফগানিস্তানে খোরাসান অঞ্চলে দায়েশ বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীটি তৎপরতা শুরু করার পরপরই কিছু স্থানীয় মানুষ এবং তালেবানের বেশ কিছু সংখ্যক বিচ্ছিন্ন সদস্য এই গোষ্ঠীতে যোগ দেয়। আর এদের পেছনে রয়েছে মার্কিন সমর্থন। বিভিন্ন উগ্র সালাফি গোষ্ঠী যেমন, পাকিস্তানি তালেবান, আফগানিস্তানের হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং উজবেকিস্তানের আদ্‌ দাওয়াহসহ অন্য চরমপন্থী গ্রুপের সংমিশ্রণে আফগানিস্তানের খোরাসানে গড়েছে দায়েশ বা আইএস জঙ্গি সংগঠন যারা এরই মধ্যে 'খোরাসানি দায়েশ' নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী 'খোরাসানি দায়েশ' খুব অল্প সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের উত্তর ও উত্তর-পূর্বের বেশ কয়েকটি গ্রামএলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং তারা আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে হামলা চালিয়ে অত্র এলাকায় তাদের প্রভাব ও উপস্থিতি জোরদার করে।

তালেবানরা ২০২১ সালের আগস্টে আবারো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত দায়েশ বা আইএস জঙ্গিকে ওই দেশে স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা বিনষ্টকারী দ্বিতীয় গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করা হতো। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের পূর্বে নানগারহার প্রদেশটি ধীরে ধীরে এই দেশে আইএস সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। আফগানিস্তানে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের প্রথম তিন বছরে, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর বিশেষ করে শিয়াদের উপর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়।

'খোরাসানি দায়েশ' নামে ভয়ঙ্কর এই জঙ্গি সংগঠন রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলার পরিকল্পনা করে। বিভিন্ন হাসপাতাল, সরকারি ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বড় বড় শহরের স্কুলগুলোতে ন্যক্কারজনক হামলা চালায়। এরফলে তারা ঘৃণিত একটি গোষ্ঠীরূপে সবার কাছে চিহ্নিত হয়ে আছে। আফগানিস্তানে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নৃশংস কর্মকাণ্ডের কারণে ২০১৮ সালের গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স অনুসারে এই গোষ্ঠীটি বিশ্বের চারটি সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি। যদিও ২০১৯ সালের শেষের দিকে এবং ২০২০ সালের শুরুর দিকে, মার্কিন সেনাবাহিনী এবং আফগানের তৎকালীন সরকার সেই সময়ে ওই গোষ্ঠীকে দমন করার দাবি করেছিল কিন্তু, 'খোরাসানি দায়েশ' বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীর অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে প্রমাণিত হয় ওই দাবি ছিল মিথ্যা এবং এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নির্মূল হয়নি।

আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বিভিন্ন কারণে জঙ্গি গোষ্ঠীতো দমেনি বরং তখন তাদের হামলার পরিধি আরো বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণেই আফগানিস্তানের সুন্নি আলেম ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন বৈঠকে তারা সকলেই উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী দায়েশ বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এমনকি আফগানিস্তানের অনেক সুন্নি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা এইসব জঙ্গিদের ধ্বংস করার জন্য গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেন।

২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে, একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল আফগানিস্তানের দায়েশ বা আইএস জঙ্গি সংগঠন। তালেবানের হানাফি মতবিশ্বাস এবং আইএস গোষ্ঠীর উগ্র ওয়াহাবি সালাফি মতাদর্শগত পার্থক্য তালেবান ও আইএসের মধ্যে সংঘর্ষের প্রধান কারণ ছিল এবং এখনো আছে। আফগানিস্তানে তালেবানের অন্যতম সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তা নাঈমুল হক হক্কানি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ইসলামি আমিরাত সরকার, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আইনশাস্ত্রের দিক থেকে সালাফিবাদ এবং আইএস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আফগানিস্তানে আমরা হানাফি মাজহাবকে অনুসরণ করি এবং সালাফিবাদ ও দায়েশ বা আইএসের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া, আফগান জনগণের মধ্যেও সালাফিবাদের  কোনো স্থান নেই। 

একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গনির আমলে তৎকালীন আফগান সরকারের একটি অংশ এবং আমেরিকানদের সমর্থন ছাড়া আফগানিস্তানে আইএসের কার্যকলাপ সম্ভব হত না। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের জাতীয় পরিষদে নানগারহার প্রদেশের প্রতিনিধি জহির কাদির বলেছিলেন, দায়েশ বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী এই প্রদেশে হেলিকপ্টার নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং তাদের পেছনে সরকারি কিছু মহলের সমর্থন রয়েছে। তার এ বক্তব্য সে সময় মিডিয়া ও জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সরকার সম্পূর্ণ নীরব ছিল।

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আফগানিস্তানের প্রাক্তন সরকার এবং তালেবানের বর্তমান সরকারের সময়েও আইএস জঙ্গিদের কার্যক্রম দুর্বলতো হয়নি বরং তারা ইরান ও পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য আফগানিস্তানের মাটি এখনো ব্যবহার করছে।

এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি নিজেদেরকে আইএস বা 'ইসলামিক স্টেট-খোরাসান প্রভিন্স' বা আইএস-কে অর্থাৎ 'খোরাসানি দায়েশ' বলে অভিহিত করে। শুরু থেকেই আফগানিস্তানের শিয়াদের উপর তাদের বেশিরভাগ আক্রমণ কেন্দ্রিভুত ছিল। দুই বছর আগেও তারা কুন্দুজ ও কান্দাহার প্রদেশে পরপর দুই সপ্তাহে জুমার নামাজের সময় নৃশংস হামলা চালিয়ে বহু শিয়া মুসলমানকে হত্যা করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পর তালেবান সরকার ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছিল এবং আফগানিস্তানের জনমনে সালাফি প্রভাবিত এই জঙ্গিদের অবস্থান আরো দুর্বল হয়ে যায়। তালেবান সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা ক্ষমতায় আসার পরপরই তাদের দুর্বলতার সুযোগে দায়েশ সন্ত্রাসীরা ওই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।

'খোরাসানি দায়েশ' বা আইএস গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইরানের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। এই গ্রুপের বেশিরভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এবং এরপর ইরানে। গত কয়েক বছরে আইএস জঙ্গিরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কিছু সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে ইরানে অন্তত পাঁচটি বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে যার পেছনে কয়েকটি আরব দেশ ও আমেরিকার সমর্থন ছিল।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ