রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে: ইউসুফ হুমায়ুন
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রেডিও তেহরানকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে ইতিহাসের ভয়াবহতম নির্যাতন বলে অভিহিত করেছেন।
পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো।
রেডিও তেহরান: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে আপনারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওই ঘটনার ব্যাপারে জোরালো কোনো ভূমিকা দেখছি না। আসলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কী ধরনের নির্যাতন চলছে বলে আপনারা জানতে পারছেন? সেখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতি যদি একটু বলেন.....।
অ্যাডভোকেট ইউসুফ হুমায়ুন: দেখুন, পত্রপত্রিকা বা মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখেছি তাতে এ কথা বলা যায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের ভয়াবহতম অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়েছে। একে এককথায় চরম নিষ্ঠুরতা বলা চলে। আমার জীবনে মিয়ানমারের মতো এত ভয়াববহতম অত্যাচার নির্যাতনের চিত্র দেখিনি।
সেখানে এক দেড় বছরের বাচ্চা শিশুদেরকে পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আসলে এসব ঘটনা সত্যিই অকল্পনীয়। বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় এত নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটতে পারে! মিয়ানমারের ঘটনা আমাদের কাছে অভাবনীয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে কিছু ভিডিও চিত্র আমি কোর্টে বসে দেখেছি । এসব ভিডিও দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। কেউ এসব দৃশ্য না দেখা পর্যন্ত বুঝতে পারবে না যে কত ভয়াবহ নির্যাতন সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হচ্ছে।
আমরা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ব্রিফিংয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে আমরা বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা মানবন্ধনও করেছি। সেই মানববন্ধন থেকে আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছি- বিশ্বের অনেক দেশকে দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বে কিছু হলে তারা মানবাধিকারের ধুয়ো তুলে তোড়পাড় শুরু করে দেয়। অথচ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর এত নিষ্ঠুর নির্যাতন চলছে সেব্যাপারে তারা নিরব। এতে আমরা অবাক হয়েছি। মিয়ানমারের ঘটনায় আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত।
আপনারা হয়ত জানেন-অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। অনেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
রেডিও তেহরান: জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এই নির্লিপ্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের ভূমিকা নিতে পারে?
অ্যাডভোকেট ইউসুফ হুমায়ুন: আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির ফলে নারী, শিশু, বয়স্কসহ সেখানকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নাগরিকেরা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। এসব লোক যাতে ভয়ভীতি ছাড়া আবাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে জরুরি ভিত্তিতে মিয়ানমারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাংলাদেশ।
এখন দেখা যাক এ ব্যাপারে তারা কী ব্যবস্থা নেয়। আমাদের সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা এ ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকারও সমালোচনা করেছি। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি জাতিসংঘ নির্লিপ্ত থাকে তাহলে তা বিশ্ব বিবেককে ব্যথিত করে। আমরাও তাদের এ ভূমিকায় ব্যথিত হই। শুধু জাতিসংঘ নয় পশ্চিমা দেশগুলো সব সময় মানবাধিকারের কথা বলে অথচ তারাও মিয়ানমারের ব্যাপারে নিশ্চূপ হয়ে আছে। এ বিষয়টিও অবাক হওয়ার মতো।
রেডিও তেহরান: রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীরবতাকে রহস্যজনক বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তিনি বলেছেন, “উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের বাঁচানো যেত।” কীভাবে দেখছেন তার এ বক্তব্যকে?
অ্যাডভোকেট ইউসুফ হুমায়ুন: দেখুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং তাদের দলের নেতারা যেসব বক্তব্য দেন সে সম্পর্কে আমি খুব ছোট করে বলব- তারা আসলে প্রতিটি বিষয়কে পলিটিক্যাল করতে চান। মিয়ানমার ইস্যুকে তো আমাদের পলিটিক্যাল করা উচিত নয়। আমি আগেই বলেছি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এবং যারা বিষয়টির সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে কথাবার্তা-আলাপ আলোচনা না করে বিষয়টির সমাধান করা যাবে না। মুখে বললেই তো সমাধান হবে না। আর সে কারণেই বলছি মির্জা ফখরুল ইসলামরা বিষয়টিকে পলিটিক্যাল করতে চাচ্ছেন। তারা যদি এখন ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে কি করতেন! মির্জা ফখরুলের বক্তব্য আসলে কথার কথা বলার জন্য বলা। বিষয়টিকে রাজনীতিকীকরণ করার চেষ্টা মাত্র। বিষয়টি নিয়ে সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে কথাবার্তা বলা ভালো। তাহলে সমাধানের দিকে যাওয়া যাবে।
রেডিও তেহরান: বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। সরকারের কী সাড়া দেয়া উচিত এ আবেদনে?
অ্যাডভোকেট ইউসুফ হুমায়ুন: দেখুন, আপনি যেকথা বললেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে- এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সেখানে মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া যাবে কি না সে বিষয়টি সরকার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছে। এরপর মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
রেডিও তেহরান: রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের এই যে ঘটনা....বিষয়টিতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? তার দলই কিন্তু এখন ক্ষমতায়।
অ্যাডভোকেট ইউসুফ হুমায়ুন: মিয়ানমারের নেত্রী এবং বর্তমানে সরকারে রয়েছেন অং সান সুচি। তাঁর ভূমিকা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলেছি। সুচির ভূমিকা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নয়। তাঁর ভূমিকা নিয়েও আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অথচ তার দেশে এখন নিষ্ঠুরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। অং সান সুচির তো নৈতিক দায়িত্ব ছিল সেখানকার হত্যা, অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করা। আমরা ওখানকার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছি। আমরা আশা করেছি- অং সান সুচি যেহেতু জীবনের সুদীর্ঘ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। ফলে তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব যে নির্যাতনের বিষয়গুলো কতখানি কষ্টকর। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আমরা তাঁর কাছে আহ্বান জানিয়েছি। আমরা আশা করি তিনি সেখানে হত্যাকাণ্ড- ও অত্যাচার নির্যাতন বন্ধে হস্তক্ষেপ করবেন।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৪