ডিসেম্বর ১০, ২০১৬ ২০:১৯ Asia/Dhaka

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে সেদেশের নাগরিক বলে মনে করছে না দেশটির সরকার। রোহিঙ্গা শূন্য করার প্রয়াস চলছে সেখানে। ভয়াবহ অত্যাচার নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ চলছে। এ অবস্থায় মুসলিম দেশগুলোর উচিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো ও দেশটির সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

রেডিও তেহরানের সাথে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো: নূর খান। পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। 

রেডিও তেহরান: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ হত্যা, দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এই আরচরণের পেছনে মূল কারণ কী বলে আপনার মনে হয়? 

মো: নূর খান: দেখুন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ হত্যা, দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের কারণ হিসেবে আমার কাছে যে বিষয়গুলো মনে হয়েছে- তা হচ্ছে- প্রথমত- রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত- রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে সেখানকার অন্য একটি গোষ্ঠীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলছে।
তৃতীয় যে বিষয়টি আমরা লক্ষ্য করছি সেটা হচ্ছে- মিয়ানমারে জাতিগতভাবে নিপীড়নটা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমান মুক্ত করার একটা অপচেষ্টা সেখানে চলছে।

রেডিও তেহরান: বলা হচ্ছে- বাংলাদেশ সরকার কেন রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য সীমান্ত খুলে দিচ্ছে না? কিন্তু সীমান্ত খুলে দিলেই কী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? এর চেয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিধর দেশগুলো যদি মিয়ানমার সরকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি ব্যবস্থা নেয় তাহলে কী বিষয়টির সহজ সমাধান আসে না? 

মো: নূর খান: দেখুন গত প্রায় ১ মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নানারকম নির্যাতন চলছে। সেখানে পুরুষদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ষণ করা হচ্ছে নারীদেরকে। বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। আর এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। তবে শুরুতে বাংলাদেশ সরকার অনুপ্রবেশ বন্ধে কঠোর অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষের চাপে একধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। এখন কিন্তু কমবেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। তাদেরকে খাবারসহ নানারকম সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে।

তবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র বাংলাদেশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। একারণে সম্ভব নয় যে – ভৌগোলিক অবস্থান এবং আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। আয়তনের তুলনায় আমাদের নিজেদের জনশক্তি অনেক বেশি। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘদিন ধরে সমাধান করা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিকমহল এবং বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর এ বিষয়ে যেভাবে সক্রিয় হওয়া দরকার তারা সেভাবে সক্রিয় হচ্ছে না। এ কারণে কখনও কখনও এমন মনে হচ্ছে যে এটি বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গার ভেতরের একটি সমস্যা। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে বিশ্ব বিবেকের একটি ভূমিকা থাকা দরকার, বিশ্ববাসীর ভূমিকা থাকা দরকার অনেক ক্ষেত্রে আমরা সেটি দৃশ্যমান দেখছি না।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব যখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অঞ্চল পরিদর্শন করছিলেন তখন তিনি যাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন তাদেরকে পরবর্তীতে সরকারি বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
  
রেডিও তেহরান: দেখুন, অনেকে রোহিঙ্গাদের ঘটনাকে বলছে গণহত্যা আবার কেউ কেউ বলছেন জাতিগত নিধন। এরসাথে আপনি যেকথাটি বললেন যে আন্তর্জাতিকমহলের নীরবতা- তো কেন এই নীরবতা।
মো: নূর খান: দেখুন, বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষ আমরা একটা বিশেষ সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। সেটা হচ্ছে ধর্মের নামে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর ততপরতা। সবক্ষেত্রে যেন মনে হচ্ছে এই জঙ্গি বিষয়টিকে সামনে এনে যেকোনো ধরনের দমন পীড়নকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও সেই বিষয়টি সামনে এসেছে।
 
রেডিও তেহরান: রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি কেন নীরব সে প্রশ্ন উঠেছে। আপনার কী মনে হয়? এবং এ ক্ষেত্রে ওআইসি আসলে কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

মো: নূর খান: দেখুন, বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলোর যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল এই ইস্যুতে আমরা তা দেখছি না। বিশ্বের যেসব শক্তিশালী মুসলিম দেশ আছে তারা যদি সহযোগিতার হাত নিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতো তাহলে আমরা একটা সহজ সমাধান খুঁজে পেতাম। কিন্তু তাদের কোনো ততপরতা দেখছি না। বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে- জঙ্গি মোকাবেলায় যে অসহনীয় ততপরতা এবং অনেক অন্যায় ও অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়া বা বৈধতা দেয়ার জায়গা থেকে অনেকেই মৌনতা প্রদর্শন করছে বলে আমি মনে করছি।

রেডিও তেহরান: রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের সময় মিয়ানমারের নেত্রী শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সুচি নীরবতা পালন করছেন। অনেকে বলছেন, তিনি নিজে একজন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ; অতএব তিনি নীরব থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। এ বক্তব্য আসলে কতটা গ্রহণযোগ্য?

মো: নূর খান: দেখুন, শান্তিতে নোবেল পাওয়া মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য। শান্তিতে নোবেল পাওয়া একজন নেত্রীর কাছ থেকে আমরা আশা করেছিলাম সেখানকার নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য একটা বলিষ্ট ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু যেকথা আগেও বলেছিলাম বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে জঙ্গি মোকাবেলার নামে বিশ্বব্যাপী অনেক অন্যায় অবিচার ও বর্বরতাকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। আর প্রকারান্তরে সেই ঘটনার শিকার মুসলিম বিশ্বের মুসলমানরা হচ্ছে।

রেডিও তেহরান: জ্বি জনাব নূর খান- মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে অন্যায়-অবিচার ও নির্যাতন হচ্ছে তা বন্ধে প্রতিবেশী দেশগুলোর পক্ষ থেকে যে ধরণের চাপ প্রয়োগ করার দরকার ছিল তা কি করা হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন।

মো: নূর খান: দেখুন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের ওপর যে ধরনের চাপ প্রয়োগ করা বা  যে ধরনের পরিবেশ তৈরি করা দরকার ছিল তা হচ্ছে না। আর এটি শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষয় নয়; বিশ্বব্যাপী যেখানে মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে সেখানেই এগিয়ে যাওয়া দরকার। বিশ্বে যেখানে মুসলমানদের নিপীড়ন করা হচ্ছে –তার বৈধতা দেয়া হচ্ছে জঙ্গিবাদ দমনের নামে। 
রেডিও তেহরান: মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যার সমাধান সহসা হবে বলে আপনি মনে করেন।

মো: নূর খান: মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংকট সমাধান সহসা হবে বলে আমি মনে করছি না। তবে এর সমাধানে মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। মুসলিম বিশ্ব এগিয়ে আসলে এই সমস্যা সমাধানের একটি সহজ পথ বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। অন্যথায় মিয়ানমার সংকটের সমাধান সুদূর পরাহত।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১০