জানুয়ারি ২৮, ২০১৭ ১৭:৪২ Asia/Dhaka

বাংলাদেশে শীতের সবজির প্রচুর উৎপাদন, সবজির দাম, সংরক্ষণের ব্যবস্থা, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম এবং কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন ফসল বা সবজি উৎপাদনের ভারসাম্যহীনতা বিষয়ে রেডিও তেহরানের সাথে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দেশটির কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। আর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান:  জনাব, শাইখ সিরাজ-অনুকুল আবহাওয়া এবং উন্নত কৃষিপদ্ধতি ব্যবহারের ফলে এ বছর শীতের সবজি উৎপাদন হয়েছে প্রচুর। প্রশ্ন হচ্ছে- কী ধরনের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করছেন দেশের সবজি চাষীরা? একইসঙ্গে আরো প্রশ্ন হচ্ছে- এই বিপুল পরিমাণ সবজির একটা বড় অংশ কী রপ্তানি করা সম্ভব? এ বিষয়ে কী ধরনের উদ্যোগ আছে?

শাইখ সিরাজ:  এ বিষয়ে প্রথমত আমি বলব উন্নত বীজ। কৃষক উন্নত বীজ তার হাতের নাগালে পাচ্ছে। আর বীজের কারণেই কৃষকের ফসলের উৎপাদন অনেক বেশি হচ্ছে। তাছাড়া গুণগত মানের দিক থেকেও ভালো সবজি কৃষক উৎপাদন করতে পারছে। আগে একজন কৃষক হয়তো এক বিঘা জমিতে ১০ মন সবজি পেত এখন সেখানে ওই কৃষক পাচ্ছে ৫০ মন সবজি।

দ্বিতীয়ত প্রযুক্তিগত সহায়তার কথা বলব। এছাড়া নতুন কলাকৌশলগত সহায়তা স্থানীয় পর্যায় থেকে কৃষক পাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃষক নিজস্ব কিছু প্রযুক্তি বর্তমানে ব্যবহার করছে। এগুলো কোনো স্বীকৃত প্রযুক্তি নয় কিন্তু কৃষক থেকে কৃষকের কাছে ছড়িয়ে যাচ্ছে এসব নিজস্ব প্রযুক্তি। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবে কৃষকের উৎপাদন বেড়েছে। আর উৎপাদন বাড়ার ফলে কৃষক বাড়তি টাকা পাচ্ছে। এরফলে কৃষকের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটছে।

আর বাড়তি ফসল রফতানির  যে বিষয়টির কথা আপনি জানতে চাইলেন- সে ব্যাপারে আমি বলব- হ্যাঁ আমাদের সবজি তো বিদেশে রফতানি হচ্ছে এবং তা থেকে অর্থ আসছে। আমি বাংলাদেশেও যেমন এ বিষয়ে কাজ করেছি একইসাথে লন্ডনেও এ ব্যাপারে কাজ করেছি। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় সবজির মার্কেট বার্মিংহামেও কাজ করেছি। সেখানকার সবচেয়ে বড় হোলসেল মার্কেট আমি ভিজিট করেছি। বাংলাদেশের সবজি সেখানে স্থানীয় যেসব দোকান আছে সেখানে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু হোলসেল মার্কেট অর্থাৎ চেইন শপে ঢুকতে পারছে না আমাদের রফতানিজাত সবজি। এর কারণ হচ্ছে  সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা কমপ্লাইনস মানি না। তারা চায় সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কেমিক্যাল কোনো সার ব্যবহার করা যাবে না। পুরোপুরি অর্গানিক সবজি তারা চায়। কিন্তু তাদের সেই চাহিদা আমরা এখনও মেনে চলতে পারছি না। যদিও দেশের দু থেকে তিনটা জেলাতে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে নরসিংদিতে কমপ্লাইনস মেনে সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে।

রেডিও তেহরান: চলতি শীত মৌসুমে সবজি উৎপাদন বেশি হলেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উৎপাদনকারী কৃষক। কারণ দাম কম হওয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। বাংলাদেশের কৃষকদের এমন দুর্দশার কথা প্রায়ই শোনা যায়। এর কারণগুলো কী? এর সমাধানই বা কী?

শাইখ সিরাজ: দেখুন, কৃষকরা দাম পাচ্ছে না বলে যে বিষয়টি সামনে এসেছে সে সম্পর্কে আমার ভিন্নমত রয়েছে। এ ব্যাপারে আমি বলব একটা হচ্ছে কৃষকের মুখের কথা আরেকটি হচ্ছে বাস্তবতা। প্রায় ৪০ বছর বয়ে গেল কৃষি নিয়ে আমি মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি। আমি অতীতে যা দেখেছি তা থেকে বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন কৃষক আগের চেয়েও অনেক বুদ্ধিমান হয়েছে। যারা মৌসুমের শুরুতেই সবজি উৎপাদন করে বাজারে আনে তারা কি পরিমাণ দামে তা বিক্রি করে সে কথা চিন্তাও করা যায় না। এ বছর সবজির ওপর গ্রামে-গঞ্জে প্রচুর কাজ করেছি। কৃষক তার নিজ বাগান থেকে একটি  মাঝারি বা ছোটো আকারের লাউ বিক্রি করছে ১৫/১৬ টাকায়। একটি বাধা কপি বিক্রি করছে ১২/১৩ টাকায়। আগে কৃষক লাউ তার বসতভিটার কাছে স্তূপ করে ফেলে রাখত এবং গরু খেত। এরকম চিত্র আমরা দেখেছি। তবে এখন আর সে চিত্র নেই। এখন কৃষক অনেক সচেতন। বিশেষ করে বীজের কারণেই কৃষক অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। কারণ সে মৌসুমের শুরুতে সবজি বাজারজাত করার জন্য একই ফসলের খেত থেকে কয়েকবার উৎপাদন করছে। আগে দেখা যেত কৃষক মাত্র দুটো ফসল তুলছে । এখন তিনটে ফসল তো দেশের সব জায়গায় উৎপাদন করছে কৃষকরা । আবার কোনো কোনো জেলায় ৪ টা ফসলও তারা উৎপাদন করছে।  এক্ষেত্রে প্রযুক্তি তাকে সহযোগিতা করেছে একইসাথে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তাও কাজে লাগিয়েছে। ফলে সে লাভবান হচ্ছে।

তবে এখনও যেটা সমস্যা সেটা হচ্ছে উৎপাদিত ফসল বা শাক-সবজির সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই দুর্বল। উৎপাদিত শাক-সবজি যথাযথভাবে আমরা সংরক্ষণ করতে পারি না। এই অবকাঠামোটা এখনও আমাদের দেশে তৈরি হয় নি।

কৃষক এখন যে কপিটা ধরুন ১০ টাকায় বিক্রি করছে যদি সে এই সবজিটা আরো ১৫ দিন পর বা ১ মাস পর বিক্রি করতে পারত তাহলে সে আরো অনেক বেশি দামে বিক্রি করতে পারত। কিন্তু সেটা  সে পারছে না কারণ তাদের সেই সংরক্ষণ করার অবকাঠামো নেই। সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় গোটা তিনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা যথেষ্ট না।

রেডিও তেহরান:  ফসলের এমন বাম্পার ফলনের সুফল পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার থাকা জরুরি বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে বাধা কোথায়?

শাইখ সিরাজ: দেখুন, যত দ্রুত গতিতে কৃষকের হাতে ভালো বীজ পৌঁছে সেই একইগতিতে বেসরকারিভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। সেভাবে বেসরকারি হিমাগার গড়ে উঠছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন ব্যবসায়ী হিমাগার তৈরি করবে কেন? সে লাভের চিন্তা করবে। এখন একজন ব্যবসায়ী দেখছে এই খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে-লাভ আসবে। ফলে এখন বেসরকারি পর্যায়ে তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। তবে আমি এখানে যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেব সেটি হচ্ছে  পিপিটির (প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশীপ)  বিনিয়োগের কথা আসলেই দেখা যায় তখন মেগা স্ট্রাকচারের বিষয়। বিশাল বিশাল রাস্তা-ঘাট বানানোর পরিকল্পনা আসে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে একজন বিত্তশালী কৃষকের সাথেও সরকার পার্টনারশিপ করতে পারে। সে বিষয়টি আমি অর্থমন্ত্রীকে বহুবার বলেছি। যেমন ধরুন কৃষক তার জমি দিল। সরকার অবকাঠামো নির্মাণের টাকা দিল। ওই কৃষক তার জমি বিনিয়োগ করে সরকারের কাছ থেকে বাকি টাকা নিয়ে বড় একটা অবকাঠামো তৈরি করতে পারে।

রেডিও তেহরান:  মফস্বল এলাকায় সবজির দাম কম হলেও রাজধানী ঢাকায় সবজি কিন্তু অতটা কম দামে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মফস্বলের সঙ্গে রাজধানীর খুচরা বাজারে দামের একটা বিরাট ব্যবধান থাকে সবসময়। অনেকেই এ জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদেরকে দায়ী করেন। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

শাইখ সিরাজ:  দেখুন মধ্যসত্বভোগীদের কোনো দিনই বিলুপ্ত করা সম্ভব না। সারা পৃথিবীতে এরা আছে। আর আমার দৃষ্টিতে মধ্যস্বত্বভোগী দোষের কিছু না। একজন কৃষকও অনেক সময় মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে থাকে।  কৃষক অনেক সময় নিজে উৎপাদন করে ১০ মন আরো ৫০ মন সে মানুষের কাছ থেকে কেনে। তারপর সে বিক্রি করছে। সেক্ষেত্রে সে কিন্তু লাভটা নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে হাতবদল যত কমানো যাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম তত কমবে।

ফিউচার সেল নিয়ে আমরা কথা বলে থাকি। অন্যান্য ক্ষেত্রে দাদনের যে কথা বলা হযে থাকে – কৃষক কিন্তু দাদন দিয়ে ফসল করে থাকে। এখন অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রে দাদন নামে না হলেও বেনামে ফিউচার সেল দেয়া হচ্ছে। বলা চলে বাংলাদেশে  এখন ফিউচার সেলের বিষয়টি চলে এসেছে। আর এরজন্য পলিসি সাপোর্ট খুবই দরকার। আর পলিসি সাপোর্টের সাথে ক্রপ বিমার ব্যাপারটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্রপ বিমার বিষয়টি আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত নেই। আর এগুলো সবই পলিসি লেবেলের বিষয়। এসব বিষয় করা গেলে কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম কমে যাবে। দেখা যাচ্ছে কৃষক তার সবজির দাম পাচ্ছে ১০ টাকা। আর ভোক্তারা খাচ্ছে ৩০ টাকায়। এর মাঝখান থেকে ২০ টাকার কোনো হদিস নেই। যদি এসব পলিসি পর্যায়ের কাজগুলো করা যায় তাহলে তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিষয়টা অনেকটাই কমে যাবে।

রেডিও তেহরান:  বাংলাদেশে কোনো বছর দেখা যায়- সবজির বাম্পার ফলন, কখনো দেখা যায় ধানের বাম্পার আবার কখনো আলুর ফলন মাত্রাতিরিক্ত। তাহলে কী বলা যায়- ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে অথবা পরিকল্পনার অভাব রয়েছে?

শাইখ সিরাজ: হ্যাঁ বলা চলে শতভাগ ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। কিন্তু কিছুই তো করার নেই। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের গাইড লাইন দেয়া হচ্ছে না। যেমন ধরুন এবার টমেটোর প্রয়োজন ৮০ লক্ষ টন। এরচেয়ে বেশি উৎপাদন করা যাবে না। কিন্তু একজন কৃষকের নিজস্ব অধিকার আছে সে টমোটোর চাষ করবে। তাকে তো নিষেধ করা যাবে না। আর যখনই কোনো সবজি বা ফসলের সরবরাহ বেড়ে যায় তখনই বাজারে তার দাম কমে যায়। তো এ বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে হয়তো আরো অনেক সময় লাগবে এ বিষয়ে একটি সন্তোষজনক জায়গায় পৌঁছতে। তবে আমি মনে করি বাংলাদেশে কৃষির একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এদিকে সরকারের আরো বেশি নজর দেয়া দরকার। সরকার যদি বিষয়টি দেখভাল করে তাহলে শৃঙ্খলা আসবে অন্যথায় এভাবেই চলতে থাকবে- কখনও ফলন বেশি হবে কৃষক মূল্য পাবে না, পচে যাবে এবং নষ্ট হয়ে যাবে।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৮

 

ট্যাগ