আগস্ট ২১, ২০১৭ ১৭:১৭ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, আজকের আসরে রয়েছে পশুরাজ সিংহ সম্পর্কে দুটি গল্প। এরপর থাকবে সিংহ সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য। আর সবশেষে থাকবে একটি ইসলামী গান।  

সিংহ, শিয়াল ও গাধা

অনেক দিন আগের কথা। বনের রাজা সিংহ, শিয়াল পণ্ডিত আর এক গৃহস্থের পোষা গাধা একটা চুক্তি করল। চুক্তিটা হলো, জঙ্গলে শিকারের সময় তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে। এতে শিকার ধরতে সুবিধা হবে। গাধা অবশ্য এসব জন্তু-জানোয়ারের গোশত নিজে খাবে না। মনিবের বাড়িতে নিয়ে যাবে। গোশত পেয়ে মনিব ভারি খুশি হবেন। তাকে অলস আর বোকা গাধা বলে গালি দেবেন না। লাঠি দিয়ে যখন-তখন পেটাবেন না।

চুক্তি অনুযায়ী, তিনজনের কাজ ভাগ করা হলো। গাধা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে ঘাড় উঁচিয়ে দেখবে কোথায় হরিণ, খরগোশ, বনগরু এসব আছেযখনই একটাকে দেখতে পাবে, অমনি সে তার সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দেবে। আর তা শুনে সিংহ ও শিয়াল বুঝে যাবে শিকার হাতের কাছেই। তখন শিয়াল হাজির হবে সেখানে। ধারালো দাঁত বের করে, লেজ ফুলিয়ে তর্জন-গর্জন শুরু করে দেবে এবং সেই পশুকে ভয় পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। ভীত পশুটি এদিক-ওদিক না গিয়ে সোজা পথ দিয়ে পালাতে চাইবে। তখন সেই পথের পাশে লুকিয়ে থাকা সিংহ থাবায় থাবায় শেষ করে দেবে তাকে। এভাবে শিকার করা পশুর গোশত তিনজনের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নেয়া হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হলো।

নির্দিষ্ট দিনে শিকারের খোঁজে জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে তারা। গাধা তার বোকা দুর্নাম ঘুচিয়ে দারুণ বুদ্ধির পরিচয় দিল। প্রথমেই সে দেখে একটি হরিণকে। তাকে দেখেই গাধা বলে, হরিণ ভাইয়া, হরিণ ভাইয়া, তোমার চোখ দুটোতে ভারি মায়া। সারা গায়ে কী সুন্দর নকশা আঁকা! শিং দুটো কেমন বাঁকা। যেন ঈদের নতুন চাঁদ। দেখতে তোমায় বড় সাধ।

গাধার এমন প্রশংসা শুনে হরিণ থমকে দাঁড়াল। সে বুঝতেই পারল না যে, এটা একটা ফাঁদ। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিয়াল হাজির। সে লেজ ফুলিয়ে হম্বিতম্বি করে হরিণকে এমন ভয় দেখাল, হরিণ তো বটেই, গাধাও ভয় পেয়ে খানিকটা পিছু হটে গেল। বেচারা হরিণ দিশেহারা হয়ে ছুট দিল সোজা পথে। এ পথে গাছগাছালি কম, জন্তু-জানোয়ারের সহজ চলার পথ এটা। আর সেই পথেরই এক পাশে বসে ছিল সিংহ। সে আর দেরি না করে ঝপাৎ করে লাফিয়ে পড়ে মড়াৎ করে ভেঙে ফেলল হরিণের ঘাড়।

এভাবে সারা দিন শিকার চলল। নিখুঁত পরিকল্পনা, নিপুণ টার্গেট। দিন শেষে হিসাব করে দেখা গেল, মোট আটটি হরিণ, একটি বনগরু আর সাতটি বুনো ছাগল মারা পড়েছে। সিংহের তো মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। এত্ত এত্ত গোশত! পরমুহূর্তে ভাবে, কিন্তু তা তো আবার তিন ভাগ হয়ে যাবে। সে কথা ভেবে তার মনে শয়তানি বুদ্ধি জেগে উঠল

গোশত ভাগ করার আগে সিংহ বলল, ভাই গাধা, তুমি আজ জব্বর বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ। কে তোমায় বোকা বলে। বনের পশুগুলোকেই তুমি আচ্ছা বোকা বানিয়েছ। তুমিই প্রথম দিন গোশত ভাগের কাজটা করো।

পশুরাজ সিংহ এতটা সম্মান দিচ্ছে দেখে গাধার খুশি আর ধরে না। সে জোরে হিপ হিপ হুররে বলে চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে যায়। কে জানে, পশুরাজ সিংহ যদি রাগ করেন! যাহোক, গাধা অনেকক্ষণ মন দিয়ে গোশত ভাগ করে। সমান তিন ভাগ হয়েছে কি না, বারবার পরখ করে। তারপর বলল, হুজুর, ভাগ হয়ে গেছে। এখন যার যার ভাগ নিয়ে চলুন বাড়ি যাওয়া যাক।

কিন্তু সিংহ কোনো কথা বলল না। থ মেরে বসে রইলশিয়াল আর গাধা এবার একটু ভয় পেয়ে গেল। কী ব্যাপার, পশুরাজের কি ভাগ পছন্দ হয়নি? তা-ও বা কেন হবে? চুক্তি মোতাবেক তো সমান তিন ভাগই হওয়ার কথা। হয়েছেও তা-ই। তাহলে পশুরাজের মুখ বেজার কেন? ওরা যখন এমন সব ভাবছে, সেই মুহূর্তে সিংহ গম্ভীরভাবে বলে, এই গাধার বাচ্চা গাধা, সমান ভাগের মানে কি এই? সব পশুই তো মারলাম আমি। তোরা শুধু পশু জোগার করে দিয়েছিস। তাতেই এ রকম সমান ভাগ নিবি? বোকা গাধা, তোর কি একটুও কমনসেন্স নেই? সমান ভাগের অর্থও তুই বুঝিস না? তোর মতো নিরেট গাধার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। নির্বোধ কোথাকার।

এ কথা বলেই সিংহ গাধার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করলকিছুক্ষণের মধ্যেই গাধার গোশতও জড়ো করা হল অন্য মাংসের সঙ্গে। তা দেখে শিয়াল পণ্ডিতের কম্মকাবার। কিন্তু তার তো অনেক বুদ্ধি। তাই সে সাহস করে বসে থাকল সিংহের সামনে।

এবার সিংহ শিয়ালকে বলে গোশত ভাগ করার জন্য বললশিয়াল প্রায় সব গোশত এক পাশে রাখলঅন্য পাশে রাখে অল্পকিছু গোশততারপর বড় ভাগ দেখিয়ে সিংহকে বলে, মহারাজ, এই ভাগ আপনার, নিন। সমান দুই ভাগে ভাগ করেছি। ভাগ দেখে সিংহের মুখে তখন হাসির ফোয়ারা। খুশিতে দুই চোখ তার চিকচিক করে উঠলসে হাসতে হাসতে বলল, পণ্ডিত, তোমার তো খাসা বুদ্ধি। তা, এমন সুন্দর ভাগ তুমি কোথায় শিখলে?

শিয়াল পণ্ডিত তখন বল, মহারাজ, এমন সুন্দর ভাগ করতে শিখেছি বোকা গাধার পরিণতি দেখে। সে যদি একটু বুদ্ধি করে আমার মতো ভাগ করতে পারত, তাহলে কি তার জীবন যায়?

এই বলে সে মহারাজকে সালাম দিয়ে গোশত ফেলেই চম্পট দিল। সিংহ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিয়াল পগারপার। এই ঘটনার পর থেকে আর কোনো দিন শিয়ালকে সিংহের সঙ্গে শিকারে অংশ নিতে দেখা যায়নি।

সিংহ ও ইঁদুর

একদিন দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া শেষে পশুরাজ সিংহ আরামে ঘুমাচ্ছিল। এমন সময় কোত্থেকে এক দুষ্টু ইঁদুর এসে তাকে উৎপাত করতে শুরু করল। পশুরাজের সারা গা জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করে তার আরামের বারোটা বাজিয়ে দিল। কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে কার না রাগ হয়, আর পশুরাজ বলে কথা! কার এমন দুঃসাহস যে তার ঘুম ভাঙায়। রাগে দাত কড়মড় করতে করতে চারদিকে তাকাতে লাগল সিংহ। আর ঠিক তক্ষুণি দেখতে পেল দুষ্টু ইঁদুরটাকে। পশুরাজ তাকে বলল, "সামান্য ইঁদুর হয়ে তোর এত সাহস। দাঁড়া তোকে আমি আজ খেয়েই ফেলব।"

এই বলে পশুরাজ বিশাল থাবা মেলে ইদুরটাকে ধরে বিরাট হাঁ করে খেতে গেল। আর যেইনা সিংহ তাকে খেতে গেল, ঠিক তক্ষুণি ইঁদুরটা কেঁদে কেঁদে বলল, "আপনার দুটি পায়ে পড়ি মহারাজ, ক্ষমা করুন আমায়। আমার অন্যায় হয়ে গেছে। একবারটির জন্য আমাকে ছেড়ে দিন। আপনার এই মহানুভবতার কথা আমি কক্ষনো ভুলব না। কে জানে হয়তো বিপদের দিনে আমি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি।"

পুঁচকে ইঁদুরের উপকারের কথা ভেবে পশুরাজ এমন মজা পেলেন যে আর না হেসে পারলেন না। তারপর বললেন, "যা। তোকে ক্ষমা করে দিলাম।"

কিছুদিন পরের কথা। একদল শিকারী, সিংহ শিকার করতে সেই বনে এলো। জ্যান্ত সিংহ ধরে নিয়ে রাজামশাইকে দিতে পারলে অনেক বখশিস পাওয়া যাবে। শিকারীরা সিংহ ধরার ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে লাগল। আর কি দুর্ভাগ্য! পশুরাজ সেই পথ দিয়েই তার গুহায় ফিরছিলেন। সিংহ তো আর জানে না তার জন্য সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করছে।

দূর থেকে তাকে আসতে দেখে শিকারীরা সজাগ হয়ে থাকল। যেইনা পশুরাজ ফাঁদের উপর পা দিয়েছ, অমনি এক হ্যাঁচকা টানে শিকারীরা তাকে ধরে ফেলল। বড় এক গাছের সাথে তারা পশুরাজকে ভালো করে বেঁধে রাখল। তারপর তারা গেল ঘোড়ার গাড়ির খোঁজে। যাতে করে পশুরাজকে রাজার কাছে জ্যান্ত হাজির করতে পারে। পশুরাজ দড়িদড়া ছিড়ে মুক্ত হবার কতই না চেষ্টা করল, কিন্তু কোন ফল হল না। মনের দুঃখে গাছতলাতে বসে রইল সিংহটি।

এমন সময় ভাগ্যচক্করে সেই দুষ্টু ইঁদুরটা ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। সে দেখতে পেল পশুরাজকে। দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রাজার করুণ হাল দেখে তার ভীষণ মায়া হলো। সে তক্ষুণি তার ধারালো দাঁত দিয়ে ফাঁদের দড়িগুলো কেটে দিল। আর দুষ্টু হাসি দিয়ে পশুরাজকে বলল, "কি মহারাজ, বলেছিলাম না যে আমি একদিন আপনার উপকার করতে পারি?"

ছোট্ট বন্ধুরা, এই গল্প থেকে কী শিখলে তোমরা? যদি কারো প্রতি তুমি দয়া দেখাও একদিন তার পুরস্কার পাবেই।

সিংহ

সিংহ সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য

সিংহ ফেলিডি পরিবারের প্রাণী যা প্যানথেরা গোত্রের চারটি বৃহৎ বিড়ালের একটি। সিংহের মূলত দুটি উপপ্রজাতি বর্তমানে টিকে আছে। একটি হল আফ্রিকান সিংহ অপরটি হল এশীয় সিংহ।  বর্তমানে আফ্রিকার বনে ৩০,০০০ সিংহ রয়েছে। আর এশিয়া ৩৫০ টি সিংহ রয়েছে। তারা এশিয়া বাস করে গির বনে।  

পুরুষ সিংহের সাধারণত ওজন হয় ১৫০ এবং ২৫০ কিলোগ্রাম এর মধ্যে হয়। বড় সিংহ পৌঁছায় ২৫০ থেকে ২৭০ কেজি পর্যন্ত। স্ত্রীরা সাধারণত ১২০ থেকে ১৮২ কেজি পর্যন্ত হয়। একমাত্র পুরুষ সিংহদের কেশর থাকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রায় ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি থেকে ৮ ফুট ২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সিংহ মাংসাশী প্রাণী। বিভিন্ন জাতের হরিণ, জেব্রা, বুনো মহিষ, জিরাফ, শূকর ইত্যাদি এদের প্রধান খাদ্য।

একটি পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ সিংহ সাধারণত ১২ থেকে ১৪ বছর বাঁচে। অপরদিকে, একটি পূর্ণ বয়স্ক মেয়ে সিংহ সাধারনত ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

শিশু সিংহ জন্মের পর অন্ধ থাকে; তারা ১ সপ্তাহ বয়সে চোখ খুলতে পারে এবং যতদিন ২ সপ্তাহ বয়স না হয় ততদিন ভালো করে দেখতে পারে না। সিংহদের নির্দিষ্ট বাসা নেই, যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। সিংহদের নির্দিষ্ট পালানোর জায়গা থাকে। যেটি তারা গোপন রাখে। যদি অন্য দলের সিংহ দেখে ফেলে; তাহলে তারা সেই স্থান ত্যাগ করে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২১

ট্যাগ