ডিসেম্বর ০২, ২০১৭ ১৮:০১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছিলাম, বিশ্বনবী (সা.) মসজিদে বসে মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। বিভিন্ন উপলক্ষে মসজিদে তাঁর দেয়া খুতবা থেকে মানুষ ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করত।

ঈমান ও আকীদার মতো ধর্মীয় মূল ভিত্তিগুলো নিয়েই বেশিরভাগ বক্তব্য দিতেন আল্লাহর রাসূল। মধ্যযুগের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আমাদের নবীজী (সা.)। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেই তিনি শিক্ষিত লোকদেরকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজে নিয়োজিত করেন। তাঁর নির্দেশে আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ এবং উবাদা ইবনে সামিত জ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে সব মুসলমান লেখাপড়া শেখার কাজে মনোনিবেশ করেন।

সে যুগের যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করার জন্য চার হাজার দিনার ‘ফিদিয়া’ দেয়ার রীতি চালু থাকলেও বদর যুদ্ধের পর প্রত্যেক শিক্ষিত যুদ্ধবন্দীকে নিজেদের মুক্ত করার ফিদিয়া হিসেবে মদীনার ১০ জন করে নিরক্ষর লোককে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার শর্ত আরোপ করেন আল্লাহর রাসূল।

বিশ্বনবী (সা.) নিজে মসজিদে নববীতে বসে সাহাবীদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পরও পবিত্র কুরআন এবং এর আয়াতগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য শিক্ষা দেয়ার কাজ অব্যাহত থাকে। আলী ইবনে আবি তালেব (আ.), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ’সহ আরো কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী মসজিদে কুরআনের তাফসির শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন ইসলামের প্রথম মুফাসসির যারা রাসূলের সুন্নত ও হাদিস অনুসরণ করে মুসলমানদের সামনে পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলোর তাফসির তুলে ধরেছেন।

কালের পরিক্রমায় নতুন নতুন এলাকা মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ইরাকের কুফা ও বসরা এবং মিশরের ফুসতাত-এর মতো বড় বড় শহর নির্মাণ করা হয়। এসব শহরের সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে নির্মিত স্থাপনাগুলোর অন্যমত ছিল জামে মসজিদ। জামায়াতে নামাজ আদায় করার জন্য শহরের সব মুসলমান যেমন এই মসজিদে একত্রিত হতেন তেমনি মুসলিম শাসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেয়ার কাজেও এই জামে মসজিদগুলো ব্যবহার করতেন। এ কারণে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে জামে মসজিদকে তুলনামূলক বড় আকারে তৈরি করা হতো। যেমন কুফা জামে মসজিদ প্রথমবার নির্মাণ করা হয় একবারে ৪০ হাজার মুসল্লির ধারণক্ষমতা রেখে। হযরত আলী (আ.)’র শাসনামলে দ্বীন শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে এই মসজিদের ভূমিকা ছিল অনন্য। নাহজুল বালাগায় হযরত আলী (আ.)’র যত ভাষণ উল্লেখিত রয়েছে তার বেশিরভাগ তিনি এই মসজিদের মুসল্লিদের উদ্দেশে দিয়েছিলেন।

প্রথম হিজরি শতক এবং দ্বিতীয় হিজরি শতকের প্রথম কয়েক দশক মসজিদই ছিল দ্বীন শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র।  মসজিদের মধ্যে একজন শিক্ষককে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে উপবেশন করে তার ছাত্ররা দ্বীন শিক্ষা নিতেন। যে শিক্ষকের ধর্মীয় জ্ঞান যত বেশি ছিল স্বাভাবিকভাবে তার চারপাশে ছাত্রের সংখ্যাও তত বেশি হতো। মিশরের বিখ্যাত আলেম জালালুদ্দিন সুয়ুতি তার ‘আল-ইতকান’ গ্রন্থে লিখেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস মসজিদুল হারামে সমবেত জনতাকে পবিত্র কুরআনের তাফসির শোনাতেন এবং তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিতেন।ইমাম সাজ্জাদ (আ.) প্রতি শুক্রবার মদীনা মসজিদে সাধারণ মানুষকে কুরআনের তাফসির ও হাদিস শিক্ষা দিতেন। ইমাম বাকের (আ.)ও একই মসজিদে জনগণকে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন।জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান শিক্ষাদানের দিক দিয়ে পবিত্র ইমামগণের মধ্যে ইমাম সাদেক (আ.) ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী। তাঁর প্রতিটি ধর্মীয় ক্লাসে প্রায় ৪,০০০ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকতেন।

আসরের এ পর্যায়ে যথারীতি রয়েছে মসজিদ পরিচিতি।২১ হিজরি মোতাবক ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে আফ্রিকা মহাদেশের প্রাচীনতম মসজিদ, মসজিদে আমর ইবনে আস নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া, ইসলাম আবির্ভাবের পর এটি ছিল মুসলমানদের হাতে নির্মিত ১৪তম মসজিদ। এই মসজিদে যারা ধর্মীয় শিক্ষা ও খুতবা দিতেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম শাফিয়ি, লাইস ইবনে সা’দ,আবু তাহির সালাফি এবং ইবনে হিশাম।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফার নির্দেশে আমর ইবনে আস মিশর জয় করেছিলেন। আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে হামলা চালানোর আগে ‘আমর’ নীল নদের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে নদীটির পূর্ব পাড়ে তাঁবু গাড়েন। এ সময়কার একটি অননুমোদিত প্রচলিত ঘটনা হচ্ছে- একদিন একটি কবুতর আমর ইবনে আসের তাঁবুর উপর একটি ডিম পাড়ে। এরপর ‘আমর’ ওই কবুতরের বাসা ও এর আশপাশকে মিশরের নয়া রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। এ কারণে নবনির্মিত শহরটির নাম দেয়া হয় আল-ফুসতাত বা তাঁবুগুলো। এরপর ঠিক ওই কবুতরের বাসাটির স্থানে আমর ইবনে আস মসজিদ নির্মাণ করা হয়। 

এই মসজিদের মূল ভবন ছিল সাদামাটা একটি বর্গাকৃতি ঘর। খেজুর গাছ দিয়ে এই মসজিদের খুঁটি নির্মাণ করা হয় এবং পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি হয় এটির বেড়া এবং চাল নির্মাণ করা হয় খেজুর পাতা দিয়ে। মসজিদটি এত বড় ছিল যে, মিশরে মোতায়েন গোটা মুসলিম বাহিনী একত্রে এখানে নামাজ আদায় করতে পারত। এর আগের মসজিদগুলোর মতো এই মসজিদেও কোনো মিনার ছিল না। পরবর্তীতে মুয়াবিয়ার শাসনামলে মসজিদটির আয়তন দ্বিগুণ করে এতে চারটি মিনার সংযুক্ত করা হয়।

৮৫৩ খ্রিস্টাবে বাইজান্টাইনদের হামলায় আমর ইবনে আস মসজিদ ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে মুসলমানরা এটিকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং এর আয়তন আরো বৃদ্ধি করেন। আরো পরে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি মসজিদটির আরো প্রসার ঘটান। ক্রুসেডের যুদ্ধ চলাকালে খ্রিস্টানরা এই মসজিদ দখল করে এটিকে গির্জায় পরিণত করেছিল; কিন্তু মুসলমানরা এটিকে পুনর্দখল করে আবার এটির মসজিদ রূপ ফিরিয়ে আনেন। প্রথমবার ক্রুসেডের যুদ্ধ হয় ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়বার ১২৪৯ সালে। খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা প্রথম যুদ্ধে এই মসজিদে সংরক্ষিত সব কুরআন এবং আবলুস কাঠের তৈরি মিম্বরটি রোমে পাঠিয়ে দেয় এবং মসজিদের নাম রাখে মেরি গির্জা। কিন্তু পরবর্তীতে ওসমানীয় শাসনামলে এটিকে আবার মসজিদে রূপান্তর করা হয়।

আজকের আসরে দ্বিতীয় যে মসজিদ নিয়ে কথা বলব তা হলো আহমাদ ইবনে তুলুন মসজিদ। ফুসতাত শহরের আমর ইবনে আস মসজিদের পর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হচ্ছে এটি। মসজিদটিতে পাওয়া দলিল থেকে জানা যায়, ২৬৫ হিজরি মোতাবেক ৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। এই মসজিদটি এতকাল পরেও তার প্রাচীন নির্মাণ কাঠামো ধরে রেখেছে। এটি হচ্ছে মিশরের একমাত্র প্রাচীন মসজিদ যেটির মিনার তৈরি করা হয়েছিল ইরাকের সামেরা শহরের জামে মসজিদের আদলে।

আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে তুলুন ছিলেন সামেরার অধিবাসী। আব্বাসীয় শাসক মু’তাজ বিল্লাহর শাসনামলে তাকে মিশরের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। মিশরে গিয়েই তিনি জামে মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ জারি করেন। ফুসতাত শহরের উপকণ্ঠে ইয়াশকুর টিলার উপর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, তিনি স্থপতিদের এমন একটি মসজিদ তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন যা আগুনে পুড়বে না এবং বন্যায়ও যার কোনো ক্ষতি হবে না। তার নির্দেশ ছিল, আগুনে পুড়ে গোটা মিশর ভস্মীভূত হয়ে গেলে কিংবা পুরো মিশর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেলেও যেন এই মসজিদের কোনো ক্ষতি না হয়। এই নির্দেশের কারণে স্থপতিরা আগুনে পোড়ানো লাল ইট দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এছাড়া, টিলার উপর নির্মিত হয়েছিল বলে পানিতে তলিয়ে যাওয়ারও কোনো আশঙ্কা এটির ছিল না।#

 

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/২