ধরণীর বেহেশত মসজিদ: পাকিস্তানের বাদশাহি মসজিদ
গত আসরে আমরা মানুষের আত্মিক প্রশান্তি লাভের ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করেছি।
আমরা বলেছি, মসজিদে উপস্থিত হয়ে মুমিন মুসল্লিদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ও আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। একারণে নবী-রাসূলগণ তাঁদের বক্তব্যে মসজিদকে মুমিন ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল বলে উল্লেখ করেছেন। এটি এমন একটি আশ্রয়স্থল যেখানে মুমিন মুসলমানরা পার্থিব জীবনের সব ঝক্কি-ঝামেলা ও কোলাহলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মানসিক প্রশান্তি লাভ করেন। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এ সম্পর্কে মুসলমানদের উদ্দেশ করে বলেন, পার্থিব সংকট ও দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হলে নামাজ ও মসজিদের কাছে আশ্রয় নাও।

ইসলামে মসজিদকে সুমহান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মসজিদের গুরুত্ব যে কতখানি তা বিশ্বনবী (সা.) মদীনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরুতেই বাস্তবে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবার আগে তিনি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। আল্লাহর রাসূল নিজের হাতে এই মসজিদ নির্মাণের কাজে অংশ নিয়েছেন এবং এ নির্মাণকাজ যত দ্রুত সম্ভব করার জন্য সাহাবীদের নির্দেশ দিয়েছেন। মসজিদ নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য তিনি আল্লাহর এ ঘর নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কোনো কাজে হাত না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মসজিদে নববী নির্মাণের কাজ শেষ হলে তিনি এই পবিত্র ঘরে বসেই ইসলাম প্রচার এবং মুসলমানদের খোঁজখবর নেয়ার কাজ শুরু করেন। বর্তমান যুগে অন্যান্য ধর্মের যেসব উপাসনালয় দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোর সঙ্গে সামাজিক কর্মকাণ্ডের খুব একটা যোগসাজশ দেখা যায় না। কিন্তু ইসলামের নবী যে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তার সঙ্গে সমাজের মৌলিকতম কাজেরও অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ছিল। মসজিদ হচ্ছে শলাপরামর্শ করার সর্বোত্তম স্থান। কারণ, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণূ কাজ জনগণের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এই পরামর্শ করার জন্য মসজিদের চেয়ে উত্তম স্থান আর নেই।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা মতপার্থক্য, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, অভাব-অভিযোগসহ এ ধরনের যেসব সংকটের সমাধান করা দৃশ্যত কঠিন মনে করতেন সেগুলোর সমাধানের জন্য মসজিদে চলে যেতেন। রাসূলের যুগে মানুষের মধ্যে শক্তিশালী তাকওয়া থাকা, পার্থিব জীবনের প্রতি তাদের ভ্রুক্ষেপহীনতা এবং আখেরাতের জীবনকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণে এ ধরনের সংকট সমাধানের জন্য মসজিদে নালিশ জানানোর মতো ঘটনা খুব কমই ঘটত। আল্লাহর রাসূলকে স্বচক্ষে দেখে এবং তাঁর উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী থেকে শিক্ষা নেয়ার কারণে সে যুগে মুসলিম সমাজকে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হতো না বললেই চলে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সংস্পর্শে থাকার কারণেই জনগণের পক্ষে এতটা উন্নত তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

আসরের এ পর্যায়ে আমরা পাকিস্তানের বাদশাহি মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। লাহোর শহরে অবস্থিত এ মসজিদ পাকিস্তানের অন্যতম ঐতিহাসিক মসজিদ হিসেবে পরিচিত। বাদশাহী মসজিদের পরতে পরতে মোঘল সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাস ও চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রয়েছে। সর্বশেষ মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু এবং ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। বাদশাহি জামে মসজিদ পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মসজিদ হিসেবে পরিচিত। এখানে একসঙ্গে ৫০ হাজার মুসল্লি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল হিসেবেও এ মসজিদের খ্যাতি রয়েছে। বিখ্যাত লাহোর দুর্গের সামনে রয়েছে মসজিদে প্রবেশের প্রধান ফটক যা আলমগীর ফটক হিসেবে প্রসিদ্ধ। মসজিদের আয়তন বাড়ার কারণে বর্তমানে এই ফটক মসজিদের ভেতরে চলে গেছে।

দ্বিতলবিশিষ্ট এ মসজিদের ভেতরে ইমামের জন্য রয়েছে আবাসস্থল এবং রয়েছে একটি লাইব্রেরি। বর্গাকৃতির মসজিদটির প্রতিটি পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ১৭০ মিটার। লাহোরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া রবি নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছে বলে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে কোনো প্রবেশদ্বার রাখা সম্ভব হয়নি। এ কারণে মসজিদ নির্মাণের গঠনশৈলীর ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এটির দক্ষিণ প্রান্তেও কোনো প্রবেশদ্বার রাখা হয়নি। বাদশাহী মসজিদের আকৃতি ও নির্মাণশৈলীর সঙ্গে দিল্লী জামে মসজিদের অনেক মিল রয়েছে। আমরা কয়েক আসর আগে দিল্লী জামে মসজিদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম সম্রাট আওরঙ্গজেবের পিতা সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে দিল্লী জামে মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তবে দিল্লী জামে মসজিদের মিনারগুলো আটকোণবিশিষ্ট হলেও লাহোরের বাদশাহী মসজিদের মিনারগুলো বর্গাকৃতির অর্থাৎ চতুর্কোণবিশিষ্ট।

বাদশাহী মসজিদের ভেতরের চত্বরকে সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর ঠিক মধ্যভাগে রয়েছে মসজিদের মিহরাব ও মিম্বর। মর্মর পাথরে ঢেকে দেয়া মসজিদের অভ্যন্তরের সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে এই মধ্যভাগ। মসজিদের এই মূল চত্বরের উপরিভাগে স্থাপন করা হয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজ। এগুলোর মধ্যে মাঝখানের গম্বুজটি তুলনামুলক বড় এবং দুই পাশের দু’টি গম্বুজ ছোট এবং সমান আকৃতির। বড় গম্বুজটির ব্যাস প্রায় ১০ মিটার এবং ছোট দু’টির ব্যাস প্রায় সাড়ে ছয় মিটার করে। গম্বুজগুলোর শীর্ষদেশে শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পদ্মফুল।

বাদশাহি মসজিদে মাত্র দু’টি শিলালিপি রয়েছে। এর একটি মসজিদের প্রধান ফটকের উপর এবং অন্যটি মসজিদের নামাজ আদায়ের প্রধান চত্বরে স্থাপিত। প্রবেশদ্বারের শিলালিপিতে ফার্সি ভাষায় লেখা রয়েছে- এই মসজিদের নির্মাণকাজ ১০৮৪ হিজরিতে (১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে) আওরঙ্গজেবের পালক ভাই মোজাফফর হোসেন ওরফে ফিদায়ী খান কুকা’র হাতে সমাপ্ত হয়েছে।

শিখরা ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর দখলের মাধ্যমে পাঞ্জাব প্রদেশের শাসনক্ষমতা হাতে নিলে বাদশাহি মসজিদে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়। শিখরা এই মসজিদকে সামরিক বাহিনীর ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে শাসনক্ষমতার উত্তরাধিকার নির্ধারণের যুদ্ধ বেধে গেলে মহারাজা রঞ্জিত সিং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মসজিদের মিনারগুলোতে হাল্কা কামান স্থাপন করেন। লাহোর দুর্গে অবরুদ্ধ প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করার কাজে এই কামানগুলো ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে লাহোর দুর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে মসজিদেরও ক্ষতি হয়।

১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা প্রবল যুদ্ধের মাধ্যমে শিখদের হাত থেকে লাহোর শহন দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত মসজিদের এই স্থাপনাকে সেনাঘাঁটি ও গোলাবারুদ রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহার করে। মুসলমানদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই বছর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী সরকার বাদশাহি মসজিদ মুসলমানদের নামাজ আদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। তবে ব্রিটিশরা মসজিদ হস্তান্তরের আগে মসজিদের পূর্ব দিকের ভবনটিকে ধ্বংস করে ফেলে। লাহোর দুর্গে বসে যাতে মসজিদে মুসলমানদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা যায় সেজন্য দখলদার ব্রিটিশরা এ কাজ করেছিল।

১৮৬৫ সালে বাদশাহি মসজিদ পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। পাঞ্জাব সরকার মসজিদ মেরামতের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ দেয় এবং লাহোরের মুসলমানরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন। এর ফলে ১৮৭৫ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে এই মসজিদের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের কাজ করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাদশাহি মসজিদকে প্রাথমিক নকশার আদলে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ২০০০ সালে এই মসজিদের মূল চত্বরে মর্মর পাথর বসানো হয় এবং এর ফলে মসজিদের সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যায়।

বাদশাহি মসজিদের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে ১৯১৩ সালে লিবিয়ায় ইতালীয় বাহিনীর হামলার সময় এই মসজিদে আল্লামা ইকবাল লাহোরি কর্তৃক বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তির ঘটনা অন্যতম। আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের উদ্দেশ্যে যে কবিতা আবৃত্তি করেন তাতে লিবিয়ার শহীদদের স্তুতি গাওয়া হয়। এই বিশিষ্ট কবি ও ইসলামি চিন্তাবিদ প্রথম ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের ধারণা তুলে ধরেন এবং একসময় তার সে প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়। ইকবাল লাহোরি পাকিস্তানের জাতীয় কবি। তাঁর মৃত্যুর পর এই বাদশাহি মসজিদে হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এই মসজিদেরই দক্ষিণ পার্শ্বে আল্লামা ইকবালের সমাধি অবস্থিত।

বাদশাহি মসজিদের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি সিন্দুক যেখানে বিশ্বনবী (সা.), ইমাম আলী (আ.), হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা, ইমাম হোসেইন (আ.), ওয়ায়েস কুরুনি এবং শেখ আব্দুল কাদের জিলানির ব্যবহৃত সরঞ্জাম রয়েছে বলে মনে করা হয়। বর্ণনায় এসেছে, সিরিয়া ও তুরস্ক জয় করার পর আমির তৈমুর গুরগানি এই পবিত্র সরঞ্জামগুলো নিজের রাজধানী সামারকান্দে নিয়ে যান। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহাম্মাদ বাবর ভারতবর্ষে আসার সময় সেগুলো দিল্লিতে নিয়ে আসেন। মুঘল সম্রাটরা বংশ পরম্পরায় এগুলো সংরক্ষণ করেন। অবশেষে সাইয়্যেদ নুরুদ্দিন মুনাওয়ার এগুলো ক্রয় করে বাদশাহি মসজিদে ওয়াকফ করে দেন। #
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ২০
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন