'দুনিয়া-কাঁপানো সেই বিপ্লবের গৌরবময় ৩৯ বছর’ (পর্ব-১০)
ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে একটি বড় ধরনের বিপ্লব বা মহাবিপ্লব বলা যায় এ কারণে যে এ বিপ্লব নানা ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে এবং এই পরিবর্তনগুলোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বজায় রেখেছে যা প্রচলিত অন্য বিপ্লবগুলোতে দেখা যায় না।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের তিনটি বড় বৈশিষ্ট্য হল: ইসলামী বিপ্লবের মূল্যবোধগুলোকে প্রভাব-বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে অব্যাহত রাখতে পারা, পরাশক্তিগুলোর সহায়তা ছাড়াই প্রকৃত স্বাধীনতা বজায় রাখা এবং ইসলামী বিপ্লবের পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলোর একাধিপত্যকামীতাকে ভেঙ্গে দিয়েছে ইরানের ইসলামী বিপ্লব। ন্যায়বিচারকামী এ বিপ্লব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও প্রকৃত সংগ্রামের এক বড় মডেলে পরিণত হয়েছে।
জাতিগুলোকে স্বাধীনভাবে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার দেয়ার পক্ষে এবং পরাশক্তিগুলোর একপেশে নীতির বিপক্ষে কথা বলে আসছে ইরানের ইসলামী সরকার। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামী ইরানের প্রতিরোধ ও সংগ্রামের নীতি দেশে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ও তাদের পুতুল সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জেগে উঠছে মজলুম এবং সচেতন জাতিগুলো।
ইরানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক ইসলামের ব্যাপক সাফল্যে আতঙ্কিত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ। মার্কিন চিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিক হান্টিংটন এ প্রসঙ্গে বলেছেন: 'ইসলাম নিজেকে পাশ্চাত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব-ব্যবস্থার জন্য এটাই হচ্ছে মূল বিপদ।'
চমস্কির মত বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বের মজলুম ও সংগ্রামী জাতিগুলোর স্বাধীনতা ও মুক্তিকামীতা এবং ন্যায়কামীতা জোরদার হয়েছে। আর এ জন্যই ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতি ব্যবহার করছে মার্কিন সরকার যাতে অন্য কোনো দেশ বা জাতি ইরানের অনুসরণ না করে কিংবা মার্কিন আধিপত্যকামীতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে না দাঁড়ায়। কিন্তু শত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের সংগ্রামী ও বিপ্লবী নীতির সাফল্য বিশ্বের মুক্তিকামী জাতিগুলোর জন্য দিনকে দিন বড় ধরনের অনুপ্রেরণা ও সংগ্রামের আদর্শ বা মডেলে পরিণত হচ্ছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আরেকটি বড় সাফল্য হল এর ধর্ম-ভিত্তিক গণ-শাসন-ব্যবস্থা। ইসলামই জনশাসনকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে এ বিপ্লব বিজয়ের পর পরই দেশের অবিসম্বাদিত তৎকালীন নেতা ইমাম খোমেনী (র) জনগণের অংশগ্রহণ-ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা চালুর প্রশ্নে গণভোটের নির্দেশ দেন। এই গণভোটে শতকরা ৯৮ শতাংশ জনগণ গণ-ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেন। অথচ গণভোট ছাড়াই ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে পারতেন ইমাম খোমেনী। ওই গণভোটের পর ইরানে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে কিংবা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এবং প্রেসিডেন্ট পদসহ নানা ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছে এসব নির্বাচন। আর এসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বেশিরভাগ নাগরিক।
ইসলামী বিপ্লবের পর প্রায় চার দশক ধরে খোদা-প্রদত্ত নাগরিক অধিকার হিসেবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার টিকে থাকার বিষয়টি ইরানের এই বিপ্লবকে করেছে বিশ্বের সবচেয়ে গণ-ভিত্তিক বিপ্লব। প্রতি বছর এই বিপ্লবের বিজয়ের বার্ষিকীর শোভাযাত্রায় ইরানের প্রতিটি শহরের অধিকাংশ নাগরিকের অংশগ্রহণের ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এখানেই।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ধর্ম-ভিত্তিক জনগণের শাসন-ব্যবস্থার মডেল কতটা সফল- এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক জনাব মুনির হুসাইন খান বলেছেন:
''ধর্ম-ভিত্তিক গণতন্ত্র ও শাসনের ক্ষেত্রে ইরান পথিকৃৎ এবং মডেল। বিশ্ব-মুসলিম সমাজের জন্য তা বরেণ্য আদর্শ বটে। কারণ ইসলাম ধর্ম পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রসহ জীবনের সব ক্ষেত্রের বিধি-বিধান এই ধর্মে ও এই ধর্মের শরিয়তে বিধৃত হয়েছে। তাই মানব-জাতির সমৃদ্ধি ও মুক্তির জন্য যা কিছু দরকার তার সবই রয়েছে ইসলামে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যেহেতু ইসলামী জীবনাদর্শ ও শরিয়তের বিধি-বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই নিঃসন্দেহে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা সারা বিশ্বের জন্য একটি মডেল। ইসলামী অনুশাসনের ওপর ভিত্তি করে তা দিনের পর দিন বিকশিত হচ্ছে এবং তা অচিরেই অত্র এলাকায় ও সমগ্র বিশ্বে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এর ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এখন মুসলিম বিশ্বের কাছে একটি সফল ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে সমগ্র অঞ্চলে এ মডেলের যে বাস্তব প্রয়োগ তা সমগ্র বিশ্বে একটি অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হবে ইনশাল্লাহ।'
এটা স্পষ্ট জনগণই ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করেছে এবং জনগণই এ বিপ্লবকে টিকিয়ে রেখেছে। নির্বাচনসহ ইসলামী ইরানের সবক্ষেত্রে জনগণের রায়ের মত বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও সমানভাবে শ্রদ্ধাভরে মেনে চলা হয়। আর তাই ইরানি জনগণও এই বিপ্লবী ইসলামী রাষ্ট্রের নীতিমালা ও নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১২