মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৬০: কার্পেট বুনন
আপনারা জানেন যে, যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে তার একটি হচ্ছে শিল্প। স্থাপত্যশিল্প, চিত্রাঙ্কন, ক্যালিগ্রাফি, মৃৎশিল্প, অলঙ্করণ, কার্পেট বুনন, মিউজিক ইত্যাদি শিল্পে মুসলমানরা দক্ষতা অর্জন করে ইসলামী সভ্যতাকে সমৃদ্ধি দিয়েছেন।
ইসলামের আবির্ভাবের আগে আরব উপত্যকা শিল্পের দিক দিয়ে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল না। তখন পর্যন্ত শুধুমাত্র কবিতা ও গানের দিক দিয়ে আরবরা এগিয়ে ছিল। ইসলাম আবির্ভাবের পর দিকে দিকে এ শান্তির ধর্ম ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরবরা শিল্পের অন্যান্য অঙ্গনের সঙ্গেও পরিচিত হয়। বিশেষ করে তৎকালীন পারস্য ও রোম সভ্যতার সঙ্গে তাদের পরিচিতি ঘটে। ইরান, গ্রীস ও রোমের বিশাল বিশাল অট্টালিকা, গির্জা, মন্দির এবং এসব ভবনের স্থাপত্যশিল্প মুসলমানদের অভিভূত করে দেয়। এরপর মুসলমানদের প্রচেষ্টায় ইরান, গ্রীস, মিশর ও সিরিয়ার শিল্পীদের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ ইসলামী শিল্পকলার ভিত্তি রচিত হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলামের আবির্ভাবের আগেই শিল্পের নানা শাখার সঙ্গে ইরান ও রোমের অধিবাসীদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। আরবে যখন ইসলামের আবির্ভাব হয়- তার কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই রোম ও ইরান শিল্পসমৃদ্ধ ছিল। ইতিহাসে শিল্পসমৃদ্ধ যে ইরানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় তার স্থায়িত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ থেকে ৫৩৬ সাল পর্যন্ত।

মানুষের প্রকৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে ইসলামের মহান শিক্ষার সামঞ্জস্য থাকার কারণে শান্তির এ ধর্ম অতি দ্রুত বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব মুসলমানের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান। ইসলামের এ সাম্যের বাণীর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি অতি দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে। মুসলমানরা পরাজিত জাতিগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতির যোগসাজশের মাধ্যমে একটি অপূর্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, ইরান, রোম ও গ্রিক সভ্যতার সঙ্গে ইসলামের সুমহান শিক্ষা মিলে একটি অভাবনীয় মুসলিম সভ্যতার উৎপত্তি হয়।
মুসলিম শাসকরা হিজরি প্রথম শতকের শেষভাগে সুন্দর সুন্দর মসজিদ ও জাঁকজমকপূর্ণ অট্টালিকা তৈরির দিকে মনযোগী হন। তারা ইসলাম আবির্ভাবের আগে বিভিন্ন দেশে যেসব স্থাপত্য ছিল, তার চেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ স্থাপত্য নির্মাণে সচেষ্ট হন। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, ইসলামে সাধারণ জীবনযাপন করতে এবং অপচয় না করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এসব অট্টালিকা নির্মাণের সময় তা পালনের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায়নি। হিজরি প্রথম শতকে ইরান, রোম কিংবা গ্রিক স্থাপত্যবিদদের সহযোগিতায় মুসলিম সাম্রাজ্যে যেসব স্থাপত্যশিল্প নির্মাণ করা হয়, সেগুলোতে আলোচিত সভ্যতাগুলোর প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু মুসলিম শাসকদের দিকনির্দেশনায় ধীরে ধীরে স্থাপত্যশিল্পে একটি স্বতন্ত্র ইসলামী পরিচিতি তৈরি হয়ে যায়। এ কারণে হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম ভূখণ্ডে নির্মিত ভবন ও অট্টালিকাগুলোতে ইসলামপূর্ব যুগের কোন সভ্যতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম স্থাপত্যশিল্প মসজিদ, মাদ্রাসা এবং মাজার তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মসজিদ স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রধান ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়। ইবাদতের পাশাপাশি মুসলমানদের সমবেত হওয়ার প্রধান স্থান হচ্ছে মসজিদ। প্রাথমিক যুগে নির্মিত বিখ্যাত মসজিদগুলোর মধ্যে দামেস্ক জামে মসজিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। হিজরি ৭৮ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালেকের শাসনামলে দামেস্কের জুপিটার গির্জার স্থলে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। দামেস্ক মসজিদে মুসলিম স্থাপত্যবিদরা প্রথমবারের মতো বাইজান্টাইন পদ্ধতিতে দেয়ালে কাঁচের মোজাইক স্থাপন করেন। এ ছাড়া, রাসুলুল্লাহ (সা:)’র জীবদ্দশায় মক্কা ও মদিনায় যেসব মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, সেসব মসজিদের নকশা দামেস্ক জামে মসজিদে ব্যবহৃত হয়।
সে সময়কার মসজিদগুলো হতো সাধারণত: আয়তাকার। বৃষ্টি ও ঝড় থেকে মসজিদকে রক্ষা করার জন্য এগুলোর এক প্রান্তে ছাদ তৈরি করা হতো এবং অপর প্রান্ত থাকতো উন্মুক্ত। ধীরে ধীরে এসব মসজিদে মেহরাবসহ অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন ব্যবহার করা হয়। তবে দামেস্ক জামে মসজিদ তৈরির পেছনে ইরানি, ভারতীয়, মিশরীয় এবং ফিলিস্তিনি শিল্পীরা ব্যাপক মেধা ও শ্রম ব্যয় করেছিলেন। তাদের পরিশ্রমের ফলে জুপিটার গির্জার ভেতরের প্রাঙ্গণকে জামে মসজিদের উন্মুক্ত অঙ্গন হিসেবে তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে গির্জার চারপ্রান্তে রোমানদের তৈরি টাওয়ারগুলোকে মিনারে পরিণত করা হয়। দামেস্ক জামে মসজিদের দেয়ালের নিচের অংশ রঙিন মরমর পাথর দিয়ে তৈরি এবং ওপরের অংশ দৃষ্টিনন্দন মোজাইকের কাজে সমৃদ্ধ করা হয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, তখনকার খলিফাদের প্রাসাদগুলোকে আড়ম্বরপূর্ণ করার জন্য যেসব শিল্প ব্যবহৃত হতো, দামেস্ক জামে মসজিদে তার প্রায় সবগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হচ্ছে হাশেম ইবনে আব্দুল মালেকের প্রাসাদ। ১০২ থেকে ১২৫ হিজরি সালের মধ্যে নির্মিত এ প্রাসাদটিকে শীতকালীন বাড়ি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের অ্যারিহার কাছে তপ্ত মরুভূমির মাঝখানে এ প্রাসাদটি নির্মান করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, ইরানি স্থাপত্যশিল্পীরা এ প্রাসাদ নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন। উমাইয়া রাজবংশের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে নির্মিত এ প্রাসাদের বাগান ও ফোয়ারাগুলো এ ভবনকে পৃথিবীর বেহেশতে পরিণত করেছিল। এ প্রাসাদের সিংহাসন ও সিংহদ্বারসহ বিভিন্ন অংশে ইরানের সাসানি রাজবংশের শাসনামলের অনেক নকশার মিল থাকায় বোঝা যায়, এটি নির্মাণে ইরানি স্থাপত্যশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
হাশিম ইবনে আব্দুল মালিক প্রাসাদ নির্মাণের এক বছর পর উমাইয়া শাসনের অবসান ঘটে এবং ইরানের সমর্থনপুষ্ট আব্বাসিয়রা মুসলিম খেলাফত গ্রহণ করেন। আব্বাসিয়রা দামেস্ক থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদে নিয়ে আসেন। তারা বাগদাদকে রাজধানী শহরের মর্যাদায় গড়ে তোলার জন্য এক লাখ শ্রমিক নিয়োগ করেন এবং টানা চার বছর তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাগদাদ মুসলিম বিশ্বের রাজধানীতে পরিণত হয়। এ নগরী তৈরি এবং এর সাজসজ্জায়ও ইরানি স্থাপত্যশিল্পী ও শ্রমিকদের অবদান ছিল। ধীরে ধীরে বাগদাদ একটি উন্নত নগরীতে পরিণত হয়। সে যুগে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের উন্নত ও দামী দামী জিনিস বাগদাদ নগরীতে কিনতে পাওয়া যেত। ইউরোপের প্রতিনিধি যেইগমন্ড ও লেন্ডফ্রিড বলেছেন, খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলে বাগদাদ ছিল একটি সুন্দর ও দর্শনীয় নগরী। খলিফার দরবারে ছাত্রদের বিশেষ মর্যাদা ছিল।
ওদিকে আন্দালুসিয়ার মুসলমানরাও চেষ্টা করেন স্পেনের কর্ডোভাকে বাগদাদের সমপর্যায়ের একটি নগরী হিসেবে নির্মাণ করতে। এ প্রতিযোগিতার মানসিকতার কারণে হিজরি চতুর্থ শতকে কর্ডোভা মুসলিম বিশ্বের একটি উন্নত ও আধুনিক শহরে পরিণত হয় এবং এখানে শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্ন লোকজনের পাশাপাশি পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। সে যুগে নির্মিত কর্ডোভা জামে মসজিদ আজো মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২১