মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৯০ : পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নয়নে ইসলামী সভ্যতার অবদান
পশ্চিমা জগতে ইসলাম এবং মুসলমানদের অবস্থা ইসলামী ভূখণ্ডের চেয়ে অনেক আলাদা। ইসলামী ভূখণ্ড বলতে বোঝায় যেখানে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এইরকম ভূখণ্ডে মুসলমানদের জীবনযাপন আর পশ্চিমা জগতে তাদের জীবনযাপন একেবারেই ভিন্ন। এ কারণেই এইসব দেশে ইসলামের উপস্থিতি অনেক চড়াই উৎরাইয়ের সম্মুখীন। মনে রাখতে হবে পশ্চিমা জগতে ইসলাম বিস্তারের অন্যতম কারণ হচ্ছে সেসব দেশে মুসলমানদের বেশি বেশি হিজরত বা অভিবাসন।
ইউরোপ, আমেরিকায় ইসলাম বিস্তারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ঐশী এই দ্বীনটির সামাজিক এবং রাজনৈতিক আদর্শের কাছে পশ্চিমা আদর্শের ব্যর্থতা। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং এবং ইউরোপের বামপন্থীদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবার মধ্য দিয়ে সেসব দেশের জনগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে। ইউরোপের বহু নামকরা ব্যক্তিত্বও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন। এরকম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রফেসর রুজে গারুদির নাম উল্লেখ করা যায়। বলা বাহুল্য রুজে গারুদি নিজেই ইউরোপে ইসলামের প্রচারকারীতে পরিণত হয়েছিলেন।
পাশ্চাত্যে ইসলামী জাগরণের পেছনে আরো যে বিষয়টি কাজ করেছিল, তাহলো, পশ্চিমা সমাজে আধ্যাত্মিকতার চর্চা একেবারেই ছিল না। সে কারণে দ্রুত ইসলামের বিস্তার ঘটে। কেননা বিশ্ববরেণ্য চিন্তাবিদ যারা ছিলেন তারা ইসলাম নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে এর আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ হয়ে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজের জীবনকে ধন্য করেন। এই শ্রেণীর মধ্যে রয়েছেন: এডওয়ার্ড ব্রাউন, অনে মারি শিমেল, হ্যানরি কোরবানসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। ইসলামী বিশ্ব সম্পর্কে অনে মারি শিমেলের ব্যাপক জানাশুনা ছিল। সে কারণে তিনি মুসলমানদের সমৃদ্ধ সাহিত্য, আধ্যাত্মিকতার উপাচার, দর্শন ও ইসলামী জ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে গুরুত্বপূর্ণ এবং জ্ঞানগর্ভ অনেক বই পুস্তক উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণালব্ধ সেইসব সৃষ্টিশীলতায় মুগ্ধ হয়ে আরো অনেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
এছাড়াও পশ্চিমা জগতে ইসলাম বিদ্বেষের ঘটনাও মহান এই ধর্ম বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। ইসলাম বিদ্বেষের কারণে সবাই এই ধর্ম নিয়ে পড়ালেখা করতে শুরু করে। আর পড়ালেখা করতে গিয়ে সবাই ইসলামের সুমহান আদর্শের সাথে পরিচিতি লাভ করে। যার ফলে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তাঁরা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ব্রিটেনে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর মতো শয়তানী উপন্যাস প্রকাশ করে ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হয়েছে। ইউরোপের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোতে ছাত্রীদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসবের ফলে দেখা গেছে পশ্চিমা চিন্তাবিদদের আশায় গুড়েবালি হয়েছে। পাশ্চাত্যে মুসলমানদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে এই সময়টা একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে ইতিহাসে।
এ কাজগুলো করা হয়েছিল পশ্চিমা যুবকরা যেন ইসলাম থেকে দূরে থাক, কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটা। যুবকরাই বরং আরো বেশি করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। ইসলামী বিভিন্ন দলের প্রতি তারা ঝুঁকে পড়তে শুরু করে। একইভাবে মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি বা বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে পশ্চিমারা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল সেইসব পদক্ষেপও এরকম ইসলামী জাগরণের ক্ষেত্রে যে কোনো ভূমিকা রাখে নি-তা হলফ করে বলা যাবে না। অবশ্য মুসলমানিরও এইসব সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আদর্শিক বহু গ্রুপের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তাঁরা ইসলামের মূল স্বরূপ রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্যের যেসব দেশে ইসলামের বিস্তার বা জাগরণ চোখে পড়ার মতো ঘটেছিল সেসব দেশের মধ্যে ব্রিটেন অন্যতম। ব্রিটিশ মুসলিম সমাজে বিশ লাখেরও বেশি জনগোষ্ঠী থাকার কারণে সেদেশে মুসলমানদের ভালোই গুরুত্ব রয়েছে। আঠারো এবং উনিশ শতকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। সে সময়েই মুসলমানরা ব্রিটেনে যেতে শুরু করে। সর্বপ্রথম সে মুসলিম দেশ থেকে মুসলমানরা ব্রিটেনে গিয়েছিল সে দেশটি হলো ইয়েমেন। সে সময় ইয়েমেনিরা ব্রিটিশদের বাণিজ্য জাহাজে নাবিক হিসেবে কাজ করতো। সেই সুবাদেই তারা ব্রিটেনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিল। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তারা ব্রিটেনে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরি করেছিল। তবে বিট্রেনর মুসলমানদের বেশিরভাগই এসেছিল ভারত উপমহাদেশ থেকে। এ কারণে ব্রিটেনের ইসলামের রঙ এবং স্বরূপ অনেকটাই ভারতীয়।
এ কারণেই ব্রিটেনের বেশিরভাগ মুসলমানই আহলে সুন্নাত এবং হানাফি ফিকাহর অনুসারী। ব্রিটেনে মসজিদ ছাড়াও আরো বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। যেমন বিভিন্ন ইসলামী সংস্থা বা ফাউন্ডেশন, স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইসলামী কলেজ, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে লিস্টার সিটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অনেক বই পুস্তক ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শিশু কিশোরদের পাশাপাশি সমগ্র ব্রিটেনে ইসলামের দাওয়াতি কাজের জন্যে এসব বই পুস্তক ব্যাপকভাবে কাজে লেগেছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটেন জুড়ে নামাজের জামাত এবং কুরআনের ক্লাসের আয়োজন করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এভাবে ইসলামের দাওয়াতি কাজেও তারা চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
সত্তুরের দশক থেকে মুসলমানরা ব্রিটেনে তাদের উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে এবং তাদের সামাজিক অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে আইন সংস্কার করতে আন্দোলন শুরু করেছিল। এ লক্ষ্যে তারা ইসলামী সংস্থাগুলোর ইউনিয়ন বা ইউ.এম.সি, ব্রিটিশ মসজিদ পরিষদ, জামাতের ইমামদের পরিষদ, মসজিদ সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠন চেষ্টা চালিয়েছিল পারিবারিক আইনসহ বিভিন্ন আইনের সংস্কার করে ইসলামী আইন বা বিধি বিধানের অনুকূলে পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালে স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশ এবং তার বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনী (রহ) এর ফতোয়া ও পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইউরোপে ইসলামী জাগরণ নতুন একটি পর্বে উন্নীত হয়। সে সময় সমগ্র বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং সেই সুবাদে ব্রিটেনে ইসলামী বিষয় আশয় দেখাশুনা করার জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। এভাবে ইসলামের বিকাশ ব্যাপক বিপ্লবী রূপ ধারণ করে।
এইসব আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁদের ক’জনের নাম উল্লেখ করা জরুরি বলে মনে করি। বিশেষ করে লন্ডন ইসলামী সংস্থার প্রধান কলিম সিদ্দিকীর নামটি অবশ্যই নিতে হবে। তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবেও ব্যাপক সহায়তা করেছিলেন। তিনি ব্রিটেনে ব্রিটিশ মুসলিম পার্লামেন্ট গঠন করার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই ফোরামের উদ্দেশ্য ছিল অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। ১৯৯২ সালে এই পার্লামেন্টটির উদ্বোধন করা হয়।
ফ্রান্সেও ইসলামের বিকাশ ও উন্নয়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। সময় সুযোগ হলে এ নিয়েও কথা বলার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৬
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন