মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৯১ : জার্মানিতে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ লাখ
১৯৬০ এর দশক থেকে মুসলমানরা তুরস্ক থেকে জার্মানিতে হিজরত বা অভিবাসন করেন এবং মুসলমান সমাজ গঠন করেন। এখন সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশ লাখের মতো।
মুসলমানরা জার্মানিতে বহু মসজিদ, ইসলামী সংস্থা এবং ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। হামবুর্গে ইসলামিক সেন্টারের মতো মিউনিখ এবং আঁচে’তেও বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে। জার্মানিতে তৎপর এইসব ইসলামিক সেন্টারের কার্যক্রমগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুরস্ক থেকে আসা মুসলমানরাই চালিয়ে থাকে। তুরস্কের ইসলামপন্থী দলগুলো সেদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার উপযুক্ত ক্ষেত্র না পেয়ে তারা তুরস্কের বাইরে চলে যায় এবং তাদের কর্মতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করে। বিশেষ করে তারা ইউরোপের দিকে যেতে পছন্দ করতো। এভাবেই তারা জার্মানি চলে যায় এবং নিজ দেশে কাজের উপযুক্ত ক্ষেত্র না পেয়ে বাধ্য হয়ে তারা জার্মানিতে তাদের কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করে।
জার্মানিতে তাদের এরকম কার্যক্রম পরিচালনার একটি প্রতিষ্ঠান হলো ‘গোরুশ’ জাতীয় সংস্থা। ইরানেও ইসলামী বিপ্লবের বিজয় জার্মানিতে তৎপর ইসলামী দল ও সংস্থাগুলোর ভেতরে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। মুসলমানদের কর্মতৎপরতার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল তাদের সন্তানদেরকে ইসলামী শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া। জার্মানিতে মুসলমান ছাত্রদের শতকরা নব্বুই ভাগ ইসলামী শিক্ষার ক্লাসগুলোতে যায় এবং শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ছাত্র অংশ নেয় কুরআন শিক্ষার ক্লাসে। জার্মানির স্থানীয় মুসলমানরা বিশেষ করে যুবক শ্রেণী সেদেশে ইসলামী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জার্মানির একজন খ্যাতিমান মুসলিমের নাম হলো মুরাদ বেলফার্ড হফম্যান। তিনি মরক্কোতে জার্মানির রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। মুসলমান হবার পর তিনি জার্মানির সমাজে ইসলামকে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
বেলজিয়ামের মোট জনসংখ্যার সাড়ে তিন ভাগই ছিলো মুসলমানরা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা উত্তর আফ্রিকা এবং তুরস্ক থেকে এই দেশে হিজরত করে। ১৯৭০ সালের প্রথম দশকগুলোতে ব্রাসেললে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালের শেষ নাগাদ ৩০০ মসজিদ এবং হোসাইনিয়া তৈরি হয়েছিল বেলজিয়ামে। বেলজিয়ামের মুসলমানরা প্রধানত মিশরের ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড এবং মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করেছে।
হল্যান্ডেও ১০ লাখের মতো মুসলমান রয়েছে। এই সংখ্যা হল্যান্ডের মূল জনসংখ্যার ছয় ভাগ। এখানকার মুসলমানরাও উত্তর আফি্রকা এবং তুরস্ক থেকে এসেছে। ১৯৭৯ সালে হল্যান্ডে তুর্কিদের সাংস্কৃতিক ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে ইসলামী বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলার ধারা সৃষ্টি হয়। মসজিদসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইসলামিক সেন্টার এতো বেশি গড়ে ওঠে যে ১৯৮০’র দশকে সেখানে মসজিদের সংখ্যা দাঁড়ায় পঞ্চাশে। হেগের মুসলমানরা মুসলিম তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে ‘কেবলা’ নামক ম্যাগাজিন ছাপেন। এই কেবলা ইসলামী আদর্শ ও বিধি বিধানগুলোর প্রচার প্রসারে নানামুখি প্রভাব ফেলেছিল।
ইউরোপের একটিমাত্র দেশ আলবেনিয়া, যেখানে পুরো জনসংখ্যার সত্তুর ভাগই হলো মুসলমান। বলকানের ওপর ওসমানী আধিপত্যের সময় তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এদিক থেকে আলবেনিয়ার মুসলমানদের ভিত যথেষ্ট মজবুত। সেখানে কমিউনিজমের পতনের ফলে ধর্মীয় বা মাযহাবি কর্মকাণ্ড পরিচালনার উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সাবেক যুগোস্লাভিয়াতেও ত্রিশ লাখেরও বেশি মুসলমান বসবাস করতেন। দেশটি ওসমানী সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার পর ব্যাপক চাপের মুখে পড়ায় বেশিরভাগ মুসলমানই তুরস্কে চলে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর মুসলমানরা তরুণ মুসলিম বহু সংস্থা গড়ে তুলেছিল। আলহেদায়া এবং মারহামাত নামের দুটি যুব সংগঠন চেষ্টা করেছিল বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনার মতো দেশ দুটোর আদলে স্বাধীনতা অর্জন করতে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাদের শক্তি খর্ব হয়ে যায় এবং তাদের নেতাদের কেউ কারাবন্দী হয় আবার কারো বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়। ১৯৬০ এর দশকে যুগোস্লাভিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পর এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে ওঠার পর যুগোস্লাভিয়ায় মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি ঘটে। এ সময় বহু মাদ্রাসা এবং মসজিদ গড়ে উঠেছিল। মুসলিম বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আলি ইযযাত বেগোভিচ ইসলামী বিবৃতি প্রকাশ করার পর ইসলামী কর্মতৎপরতা উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়।
ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ফলেও যুগোস্লাভিয়া সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ১৯৮৩ সালে বেগোভিচ আরো ১২জন মুসলিম নেতাসহ দীর্ঘ মেয়াদে কারাবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। যুগোস্লাভিয়া আলাদা হবার পর বেশিরভাগ দেশ বিশেষ করে সার্বিয়ার মতো দেশ চেষ্টা করেছিল ইউরোপের ভেতর যেন কোনো মুসলিম দেশ গড়ে উঠতে না পারে। এই লক্ষ্যে বসনিয়ার মুসলমানদের ওপর তারা গণহত্যা চালিয়েছিল। এই গণহত্যার ফলে বসনিয় মুসলমানরা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বসনিয় মুসলমানদের মাঝে যেমন তেমনি বিশ্ব মুসলমানদের মাঝেও আত্মসচেতনতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
আমেরিকায় প্রথম পর্যায়ের মুসলমানরা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। দাস ব্যবসার জন্যে তাদেরকে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের বেশিরভাগই বাধ্য হয়েছিল নিজেদের নাম পরিচয় পরিবর্তন করতে। এর ফলে সামাজিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এক্স ফ্যামিলি’র পক্ষ থেকে এরকম একটি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। মালকুল এক্স নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ নেতার নেতৃত্বে আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনটি ছিল মূলত মার্কিন সমাজে কৃষ্ণাঙ্গদের মর্যাদাহানী করার বিরুদ্ধে এবং তাদের ওপর বিচিত্র জুলুম নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে এক ধরনের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। তিনি তাঁর নিজ ধর্ম ইসলামের জায়গায় খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। সেইসাথে ফ্যামিলি নেইম ‘লিটল’ তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না, কেননা এই নামটি শ্বেতাঙ্গ দাস ব্যবসায়ীরাই তাঁকে দিয়েছিল।
১৯৮০’র দশকে বহু মুসলমান আমেরিকায় গিয়েছিল একটা ইসলামী পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তাঁরা চেষ্টা করেছিল তাবলিগ বা প্রচারের মাধ্যমে এবং মসজিদ মাদ্রাসা, ছাপাখানা, প্রকাশনাসহ ব্যাংকের মতো অর্থনৈতিক অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছিল। এসবের পেছনে সবচেয়ে বেশি শ্রম ও মেধা ব্যয় করেছিলেন ভার্সিটি ছাত্ররা। এরপর একের পর এক গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বহু সংগঠন। এমস, এস, এ, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনগুলো এ সময়ই গড়ে উঠেছিল।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৭
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন