এপ্রিল ২৩, ২০১৮ ১৮:৫২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের ঐতিহ্যবাহী পণ্য কার্পেট নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে কার্পেট বোণার ইতিহাস এবং এই শিল্পটির সঙ্গে জড়িত জনসমষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করার চেষ্টা করেছি। আশা করি ভালোই লেগেছে আপনাদের।

আজকের আসরেও আমরা ইরানের ঐতিহ্যবাহী ওই পণ্যটি মানে গালিচা বা কার্পেট নিয়েই কথা বলার চেষ্টা করবো। বলেছিলাম যে ইরানি গালিচার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। আগে ছিল হাতে বোণা কার্পেট। এখন হাতে বোণার কার্পেটের পাশাপাশি মেশিনে তৈরি কার্পেটও ব্যাপকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। ইরানি কার্পেট কেবল একটি পণ্যই নয় এটি একটি শিল্প, সৃজনশীল শিল্প। ইরানি জাতীয় সংস্কৃতির সমষ্টিগত একটি অভিব্যক্তি ও প্রতীক এই কার্পেট। ইতিহাসের দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় এই শিল্পটি ইরানের ঐতিহ্যকে বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রেখেছে। যাই হোক চলুন সরাসরি আলোচনায় চলে যাওয়া যাক।

ইরানি কার্পেট

 

আমরা ইতোপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে কার্পেট যখন তৈরি হয়েছিল তখন মেশিনপাতি ছিল না। বাড়ি কিংবা ঘরের ভেতরে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ হাতের সাহায্যে কার্পেট বুনেছিল তখন। প্রাথমিক পর্যায়ে তো এখনকার মতো সূতোর ব্যবহার ছিল না কারণ তখন সূতোই আবিষ্কার হয় নি। সে সময় লতাগুল্ম, খেজুর পাতা কিংবা গাছের ছাল বাকলকে পিটিয়ে নরম করে মানুষ বিচিত্র সাজি বা ঝুড়ি তৈরি করতো। পরবর্তীকালে মাদুর জাতীয় জিনিস তৈরি করেছে। তারও অনেক পরে পশুর চামড়া এবং পশম ব্যবহার করে মাদুর বানিয়েছে। মেষ বা দুম্বা জাতীয় পশুকে পোষ মানিয়ে লালন পালন করার মধ্য দিয়ে কার্পেট শিল্পীরা ধীরে ধীরে ওইসব পশুর পশম ব্যবহার করে পশমি কার্পেট নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

ইরানি কার্পেট রাশিয়ার মিউজিয়ামে

 

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী প্রথম কার্পেট বোণার কাজটি করেছিল মহিলারা। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মহিলারাই কার্পেট নির্মাণের কাজটি চালিয়েছিল। তারা কার্পেট কিংবা মাদুর বুণতো। আবার গৃহপালিত পশু যেমন গাধা, মেষ বা ঘোড়ার পিঠের ওপর দেয়ার জন্য এক ধরনের জিন বা খোরজিন তৈরি করতো। খোরজিন হলো পশুর পিঠের দুইপাশে ঝুলে থাকা ব্যাগ যার ভেতর সফরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়। এগুলো মহিলারা হাতে বুণতো। এছাড়া বাজারঘাট করার জন্য ব্যাগ বানাতো তারা। ইরানের সবচেয়ে প্রাচীন কার্পেট হলো "পাজিরিক" কার্পেট। রুশ পুরাতত্ত্ববিদ এস এ. রুদাঙ্কু ১৯৪৯ সালে পাজিরিক টিলায় এবং সাকা শাহীদের সমাধিস্থলে খনন কাজ চালিয়ে ওই কার্পেট আবিষ্কার করেছিল। বিভিন্ন রঙের পশম দিয়ে তৈরি করা ওই কার্পেট যে ইরানি ছিল তার পক্ষে বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কার্পেটটি এখন রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গের 'অর্মিতাজ' মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।  

আরও কয়েকটি ইরানি কার্পেটের কথা না বললেই নয়। ঐতিহ্যবাহী এইসব কার্পেটের মধ্যে রয়েছে আর্দেবিল গালিচা, চেলসি গালিচা, শেকারগহ গালিচা, ফুলুনজি গালিচা ইত্যাদি। ইরানের ঐতিহাসিক এই গালিচাগুলোর সঙ্গে আমরা সংক্ষেপে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর্দেবিল গালিচা ইরানের প্রাচীনতম আরেকটি কার্পেট। এই কার্পেট এখন লন্ডনের "ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট " মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। কয়েক বছর আগে সানডে টাইমস পত্রিকায় এই কার্পেটটিকে বিশ্বের মাস্টারপিস ৫০ টি শিল্পের একটি বলে শনাক্ত করেছে। ডিজাইন ও বুণনের দিক থেকে ইরানের মধ্যে তো বটেই সমগ্র বিশ্বেই অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক একটি কাজ বলে পরিগণিত এই আর্দেবিল কার্পেট। ১৫৩৯ সালে বোণা হয়েছে এই কার্পেটটি।

ইরানি কার্পেট লন্ডনের "ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট " মিউজিয়ামে

 

চেলসি গালিচাও অপর একটি বিখ্যাত ইরানি কার্পেট। এই কার্পেটটিও "ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট " মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এই গালিচাটি 'কিংস চেলসি' সড়কের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা হয়েছিল বলে এই নাম খ্যাতি লাভ করেছে।রূপকথার অনেক জন্তু জানোয়ারসহ অনেক বুনো পশুর ছবি আঁকা রয়েছে এই কার্পেটে। অবশ্য এ ধরনের নকশাই সে সময়কার কার্পেটের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।

ভিয়েনার 'শিল্প যাদুঘরেও সাফাভি শাসনামলের আরেকটি নামকরা ইরানি কার্পেট শোভা পাচ্ছে। ওই কার্পেটের নাম 'শেকারগহ গালিচা'। এই গালিচাটি সম্পূর্ণ রেশমি সূতোয় বোণা। শাহ আব্বাস সাফাভির আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় ষোল শতকের শুরুর দিকে এই কার্পেটটি বোণা হয়েছিল। ইরানি এই শাহ কীভাবে শিকার করতো সেই দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই কার্পেটে।

আমেরিকার নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম বিশ্বের আরেকটি নামকরা যাদুঘর। ওই যাদুঘরেও রয়েছে ইরানের অন্তত দুই জোড়া বিখ্যাত কার্পেট।  সাফাভি শাসনামলের এই গালিচাগুলো 'ফুলুনজি' নামেই পরিচিত। পোল্যান্ড থেকে এই ফুলুনজি শব্দটি এসেছে বলে অনেকের ধারণা। ফুল, লতাপাতার ডিজাইনেই এই শ্রেণীর কার্পেটগুলো বোণা হয়েছে। পোল্যান্ডের রাজ পরিবারের সঙ্গে মিল রয়েছে-এরকম একটি ডিজাইনের কার্পেট সর্বপ্রথম প্যারিসের আন্তর্জাতিক মেলায় প্রদর্শনী করা হয়েছিল ১৮৭৮ সালে। পোল্যান্ডের শাহজাদা চরতোরিস্কির বিভিন্ন মালামালের মধ্যে ওই কার্পেটটিও প্রদর্শন করা হয়েছিল। সেই থেকে এই কার্পেট 'লাহেস্তানি' নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ফার্সি ভাষায় পোল্যান্ডকে লাহেস্তান বলা হয়। তবে পরবর্তীকালে রিগ্যাল নামের এক গবেষক বলেছেন এই কার্পেট পোল্যান্ডের কিনা-সন্দেহ আছে।

এরপর মার্টিন এবং বোড নামের আরও দুই গবেষক বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বলেছেন: নি:সন্দেহে ওই কার্পেট ইরানি। প্রমাণিত হয়ে যাবার পরও এখনও কার্পেটের নামে কোনো পরিবর্তন আসে নি। এই শ্রেণীর কার্পেটগুলো ইরানের রাজ প্রাসাদের জন্য বোণা হত। রাজা বাদশাহরা ইউরোপীয় শাসকদেরও এইসব কার্পেট উপহার দিতেন। এ কারণেই আমেরিকার নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম, ক্লিভল্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম, সান মার্কো গির্জা, মিউনিখের রেসিডেন্স প্যালেস, ডেনমার্কের রোজেনবার্গ ক্যাসল'সহ বিশ্বের আরও বহু মিউজিয়ামে ইরানি কার্পেট দেখতে পাওয়া যায়।

বর্তমানে ইরানে আরও বহু উন্নত ও আধুনিক ডিজাইনের কার্পেট তৈরি হচ্ছে। আজ আর সেসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। পরবর্তী আসরে চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২৩

ট্যাগ