সূরা আল আহযাব: আয়াত ২৬-৩১ (পর্ব-৭)
কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা আল আহযাবের ২৬ থেকে ৩১ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَأَنْزَلَ الَّذِينَ ظَاهَرُوهُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ صَيَاصِيهِمْ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ فَرِيقًا تَقْتُلُونَ وَتَأْسِرُونَ فَرِيقًا (26) وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيَارَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ وَأَرْضًا لَمْ تَطَئُوهَا وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرًا (27)
“আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের সুদৃঢ় দূর্গ থেকে নামিয়ে দিলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি ও শঙ্কা নিক্ষেপ করলেন। ফলে তোমরা (তাদের) একদলকে হত্যা করেছ এবং একদলকে বন্দী করেছ।” (৩৩:২৬)
“তিনি তোমাদেরকে তাদের ভূমি, ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদের এবং এমন এক ভূখণ্ডের মালিক করে দিলেন, যেখানে তোমরা অভিযান করনি। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (৩৩:২৭)
ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, মদীনায় ইহুদিদের তিনটি গোত্র বাস করত যাদের প্রত্যেকটির সঙ্গেই মুসলমানদের সন্ধি চুক্তি ছিল। এদের মধ্যে দু’টি গোত্র দ্বিতীয় ও চতুর্থ হিজরিতে চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুই গোত্রকে মদীনা থেকে বের করে দেয়া হয়। তবে বনি কুরাইযা নামের তৃতীয় গোত্র তখনও মদীনায় বাস করছিল। পঞ্চম হিজরিতে আহযাবের যুদ্ধের সময় এই ইহুদি গোত্রটি মক্কার কাফেরদের সঙ্গে গোপনে মিত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে মক্কার কাফেররা পরাজিত হলে ভয়ে ইহুদিরা ভয়ে নিজেদের দুর্গে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে এই নির্দেশ পান যে, সন্ধির চুক্তি ভঙ্গকারী এই ইহুদি গোত্রকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। এ কারণে মুসলমানরা বানি কুরাইযা গোত্রের দুর্গ অবরোধ করেন এবং কিছুদিনের মধ্যে এক সংঘর্ষে ওই দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। যারা দুর্গের প্রবেশমুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তারা এ সময় নিহত হয়। তবে ইহুদিদের বেশিরভাগ মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পন করে করে। এই যুদ্ধের পরিণতিতে সন্ধির চুক্তি ভঙ্গকারী তৃতীয় ইহুদি গোত্রটিকেও মদীনা থেকে বের করে দেয়া হয়। এই যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গণিমতের মাল মুসলমানদের হস্তগত হয়। এসব সম্পদের মধ্যে ছিল প্রচুর বাগান ও কৃষিজমি যেগুলো মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. ইসলাম অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে। তবে অমুসলিমরা ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে যতক্ষণ তারা সন্ধির শর্ত মেনে চলবে। ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে গোপনে হাত মেলালে তারা আর নিরাপত্তা পাবে না।
২. শত্রুদের অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ও সামরিক স্থাপনা দেখে মুসলমানদের ভয় পেলে চলবে না। কারণ, কখনও কখনও মহান আল্লাহ শত্রুর অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে তাদের ওপর বিজয়ী করে দেবেন।
সূরা আহযাবের ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا (28) وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآَخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا (29)
“হে নবী! আপনার পত্নীগণকে বলুন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার বিলাসিতা কামনা করো, তবে আসো, আমি তোমাদের ভোগের ব্যবস্থা করে দেই (অর্থাৎ তোমাদের মোহরানা আদায় করে দেই) এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় জানাই।” (৩৩:২৮)
“পক্ষান্তরে যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও পরকাল কামনা কর, তবে তোমাদের সৎকর্মপরায়ণদের জন্য আল্লাহ মহা পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।” (৩৩:২৯)
আহযাব যুদ্ধের ঘটনা শেষ হওয়ার পর এই সূরার শুরুর প্রসঙ্গে আবার ফিরে যাওয়া হয়েছে যেখানে রাসূলের স্ত্রীদের প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এই দুই আয়াতে রাসূলের স্ত্রীদের উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, বিশ্বনবী (সা.)’র মতো আপনাদেরকেও মুসলিম নারী ও কন্যাদের জন্য উত্তম আদর্শ হতে হবে। রাজা-বাদশাহদের স্ত্রীদের মতো সোনা-রূপা, হীরা-জহরত ও মণি-মুক্তা আশা করলে চলবে না। বিলাসিতাপূর্ণ জীবন আপনাদের জন্য নয়।
সার্বিকভাবে যে রাসূলুল্লাহকে সব মুমিনের জন্য আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তাকে সব দিক দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্বকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে। কাজেই তিনি তো তাঁর স্ত্রীদের প্রতি অবশ্যই এই নির্দেশ জারি করবেন যে, রাসূলের স্ত্রী হয়েছো ভেবে তোমরা একথা ভেবো না যে, অন্য সব স্ত্রীদের চেয়ে তোমরা অধিক বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন করবে। যদি সেরকম আকাঙ্ক্ষা করো তাহলে আমার জীবন থেকে সরে যেতে হবে। কিন্তু যদি তোমরা অন্য সব মুসলিম নারীর মতো সাধারণ জীবনযাপন করতে প্রস্তুত হও তাহলে তোমাদের মধ্যকার নেক আমলকারীদেরকে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন অনেক বড় পুরষ্কার দান করবেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে:
১. মুসলিম সমাজের নেতাদের পরিবারকে বিলাসিতাপূর্ণ জীবন পরিহার করতে হবে। এ ধরনের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপন প্রণালির প্রতি সাধারণ মানুষ গভীর নজর রাখেন।
২. মুসলিম সমাজের নেতারা যেন কোনো অবস্থাতেই নিজেদের অবস্থান ও মর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত না করেন।
৩. ইসলামি সংস্কৃতিতে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামি দিক-নির্দেশনাকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে। ইসলাম বিরোধী কোনো কিছু চাইলে তা পূর্ণ করতে স্বামী বা স্ত্রী বাধ্য নয়।
এই সূরার ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا (30) وَمَنْ يَقْنُتْ مِنْكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ وَتَعْمَلْ صَالِحًا نُؤْتِهَا أَجْرَهَا مَرَّتَيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهَا رِزْقًا كَرِيمًا (31)
“হে নবী পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। এটা আল্লাহর জন্য সহজ।” (৩৩:৩০)
“তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুগত হবে এবং সৎকর্ম করবে, আমি তাকে দুবার পুরস্কার দেব এবং তার জন্য আমি সম্মানজনক রিযিক প্রস্তুত রেখেছি।” (৩৩:৩১)
এই দুই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, অন্য মুসলিম নারীরা তোমাদের ভালো ও মন্দ কাজ ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করে। কাজেই রাসূলের স্ত্রীরা ভালো বা মন্দ যে কাজই করুক না কেন তা থেকে অন্য মুসলিম নারীরা প্রভাবিত হয়। এ কারণে আপনাদের নেক বা বদ আমলের পুরষ্কার বা শাস্তি সাধারণ নারীদের মতো হবে না। কারণ, একদিকে আপনারা ওহী নাজিলের ঘরে বসবাস করছেন এবং ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন। অন্যদিকে আপনাদের আচরণ ও কাজ অন্য মুসলিম নারীরা অনুসরণ করছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. আল্লাহর পুরষ্কার ও শাস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির এলম বা জ্ঞানের যেমন ভূমিকা রয়েছে তেমনি সমাজের অন্য মানুষের ওপর তার আচরণের প্রভাবও বিবেচনা করা হবে।
২. আল্লাহর ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় নেতাদের আত্মীয় স্বজন এমনকি তিনি যদি নবীও হন তাহলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাজাত পাবেন না। এমনকি তারা যদি খারাপ কাজ করে বসেন সেজন্য তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে।
৩. সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের গোনাহ সাধারণ মানুষের খারাপ কাজের সমান নয়। অনেক সময় তাদের ছোট ছোট গোনাহ সাধারণ মানুষের অনেক বড় গোনাহর চেয়েও মারাত্মক হয়। এ কারণে ধর্মীয় নেতাদের খারাপ কাজের পরিণতি হবে সাধারণ মানুষের চেয়ে ভয়াবহ।#