জুলাই ০৮, ২০১৮ ১৮:৫৮ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭২ :  ইহুদিবাদী নেতার স্বপ্ন ছিল একটি ইহুদি ভূখণ্ড সৃষ্টি করা

গত পাঠে আমরা দেখার চেষ্টা করেছি কীভাবে ইঙ্গো-মার্কিন, জার্মানি, হল্যান্ডি, পর্তুগিজ উপনিবেশবাদীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় প্রবেশ করে তাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটিয়েছিল।

আর প্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘদিন যাবত অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছিল। আজকের পাঠে আমরা দেখার চেষ্টা করবো ইহুদিবাদীদের কারণে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে উপনিবেশবাদীরা কীভাবে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে।

ইহুদিবাদের আজকের যে রূপ তা গঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের শুরুতে। ইহুদিবাদী চিন্তাদর্শের মূলে রয়েছে আধিপত্যবাদ। মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ভূগোলের প্রাণকেন্দ্রে ইসলাম বিরোধী একটি ইহুদিবাদী ভূখণ্ড গড়ে তোলা তাদের টার্গেট। যাতে ধীরে ধীরে উগ্র বর্ণবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তাদের কাল্পনিক আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। আর এই ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ডেকে এনে এই দেশটির ওপর দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করতে পারে। অবশ্য বলা যেতে পারে মুসলিম বিশ্বের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চিন্তা শুরু হয়েছিল সেই ক্রুসেড যুদ্ধের সূচনা থেকেই। এরপর তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাবে মুসলমানদের বোধ ও বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্বের মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পেরেছিল। গেল অর্ধ শতাধিক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ঐ যুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের বিশাল সম্পদ ধ্বংস করেছে ইহুদিবাদীরা। সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত এই যুদ্ধের পরিণতিতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদীদের জোটবদ্ধতার পালা শুরু হয় মুসলিম সরকারগুলোর দুর্বলতা বিশেষ করে আঠারো শতক থেকে ওসমানী সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে ইহুদিবাদীদের এক নেতা থিয়োডর হার্তজেলের একটি স্বপ্ন ছিল একটি ইহুদি ভূখণ্ড সৃষ্টি করা। ঐ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাফল্যের মধ্য দিয়ে। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বেলফোর ঘোষণার মাধমে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয় এবং বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে।

ফিলিস্তিন দখল করার ঘটনাটা মুসলমানদের জন্যে ছিল চরম এক আঘাত। এর ফলে মুসলমানদের ওপর গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ইহুদিবাদীরা তাদের আধিপত্য শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সময় ইহুদিবাদীরা জর্দান, সিরিয়া এবং লেবাননের কিছু কিছু ভূখণ্ডও দখল করে নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ইহুদিবাদী সরকার নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষণা দেওয়ার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ইহুদিরা এই ভূখণ্ডে এসে সমবেত হতে শুরু করে। এক অস্বাভাবিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে জনবসতির বিন্যাস ইহুদিদের জন্যে ইতিবাচক সুবিধা বয়ে এনেছিল। আসলে ইহুদিবাদী চিন্তাদর্শের মূল লক্ষ্য কেবল যে একটি মাযহাব গঠনই ছিল না তা-ই নয় বরং তাদের টার্গেট ছিল ইহুদিদের সমবেত করে এমন একটি জাতি বা সরকার গড়ে তোলা যাদের মাধ্যমে বায়তুল মোকাদ্দাসে তাদের আধিপত্যবাদ বিস্তারের যুদ্ধে পৃথিবীর সকল ইহুদিকে ব্যবহার করা যায়। আধিপত্যকামিতা ইহুদিবাদীদের রক্ত-মাংসে মিশে আছে। কেননা তারা চেয়েছিল তথাকথিত ইসরাইল রাষ্ট্রটিকে সেই নীলনদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত বিস্তৃত করতে।     

ইহুদিবাদী সরকার গঠিত হবার পর থেকেই পরমাণু ও সামরিক তৎপরতায় লেগে যায় এবং ১৯৫২ সালেই পরমাণু শক্তি কমিটি গঠন করে এবং ১৯৫৫ সালে রিঅ্যাক্টর তৈরির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ ছাড়াও গোপনে গোপনে ফ্রান্সের সাথে পরমাণু তৎপরতা চালিয়ে যায় এবং এ আলোচনার পথ ধরেই ১৯৬৩ সালে ইসরাইল ‘দিমোনা’ নামের পরমাণু কেন্দ্রটি নির্মাণ করেছিল। কুদস দখলদার এই ইসরাইল আজ পর্যন্তও তাদের রি-অ্যাক্টর পরিদর্শন বা পর্যালোচনা করার অনুমতি আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে দেয় নি। তবে যেটুকু জানা গেছে তাহলো দিমোনা রিঅ্যাক্টরের শক্তি বর্তমানে ২৪ মেগাওয়াট যা বছরে একটি পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরির প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের জন্যে যথেষ্ট।

ইসরাইল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করার পর নিজেদের পরিধি বিস্তারের জন্যে আরব বিশ্বসহ মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। বিভিন্ন ফের্কার মাঝেও তারা এই বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপন করে। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ইহুদিবাদীরা সিরিয়ার গোলান মালভূমিসহ বিভিন্ন এলাকার প্রতি তাদের আধিপত্যবাদী শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তারা গোলান মালভূমিকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে মনে করতো। ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা ডেভিড বেনগোরিয়ান যেমনটি চেয়েছিলো যে ইয়ারমুক আর জর্দান নদীর পানিতে দখলদারিত্ব আরোপ করার মাধ্যমে এই গোলান মালভূমি দখল করে নেয়া যাবে। তাই করেছিল এমনকি এর পরে তারা জর্দানের আরো দুই তিনটি নদী দখল করে নিয়েছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় তারা জর্দান নদীর গতিপথেও পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিল। সেইসাথে দখল করে নিয়েছিল ফিলিস্তিনের বহু কৃষিজমিও।

সামরিক দখলদারিত্বের বাইরেও ইহুদিবাদীরা গণমাধ্যমগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালায় এবং তাদের প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে সফলও হয়। পৃথিবীর বিখ্যাত বার্তা সংস্থাগুলোর অধিকাংশের ওপর এবং বহু টিভি চ্যানেলের ওপর তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলোর একটাই লক্ষ্য তাহলো ইহুদিবাদী ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার্থে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো। তারা ইসলাম অবমাননা করা, নবীজীর মর্যাদাহানীকর কার্যক্রম পরিচালনার মতো নিকৃষ্ট ও অশোভন ও অমানবিক, অসৌজন্যমূলক কাজের জন্যে এইসব মিডিয়াসহ হেন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা কাজে লাগায় নি।

কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলীদের পাশবিক নির্যাতন, দমন পীড়ন আর বংশ নিধনযজ্ঞ চালানোর পরও এখনো ফিলিস্তিনীরা তাদের ইসলামী পরিচয় ও স্বরূপ ধরে রাখতে পেরেছে এমনকি ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে এখনো তারা ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ঘটনায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রেরণাদায়ক প্রভাব পড়েছে। একই প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফিলিস্তিনের সত্যকামী ও স্বাধীনতাকামী যুবকরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাদের সেই আন্দোলন সফল হোক সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এবং স্বাধীনতাকামী বিশ্ববাসী তাই কামনা করছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/  ৮