জুলাই ১৮, ২০১৮ ২০:৫৬ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭৩ : পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

“মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের লিবারেল ডেমোক্রেসি এবং সেক্যুলারিজম মতবাদের বিস্তার ঘটাতে।

এগুলোর বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে অন্যান্য সমাজের দ্বীনী বিশ্বাসগুলোতে রূপান্তর আনতে চায় পাশ্চাত্য। লক্ষ্য হলো পশ্চিমা চিন্তাদর্শের বাইরে যেসব ধর্মবিশ্বাস বা মতবাদের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করানো। কিন্তু ইসলামী দ্বীন সেক্যুলারিজমের বিশ্বাসের বিপরীতে রাষ্ট্র এবং সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।”

বিগত আসরগুলোতে বলেছিলাম উপনিবেশবাদী সরকারগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে, প্রাচ্যের দেশগুলোকে এবং বিশেষ করে মুসলমানদেরকে কীভাবে তাদের ভয়াবহ ও পাশবিক ছোবলের নাগপাশে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। সেইসাথে কীভাবে তারা মুসলমানদের প্রাকৃতিক ধন সম্পদগুলোকে লুটপাট করে নিয়ে নিজেরা ধনী এবং শিল্পোন্নত হয়েছিল আর মুসলমানদেরকে পশ্চাদপদ সমাজে পরিণত করেছিল। দুঃখজনকভাবে বলতেই হয় যে উপনিবেশবাদী বিশেষ করে পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিস্তার মুসলিম বিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল। যার ফলে এইসব দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছিল লিবারেল ডেমোক্রেসি, হিউম্যানিজম এবং সেক্যুলারিজম। এইসব চিন্তাদর্শ বা মতবাদের প্রভাবে প্রাচ্যের  দেশগুলোর অবস্থা কীরকম দাঁড়িয়েছিল সে বিষয়টি নিয়ে আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো।

উপনিবেশিক সরকারগুলো বিশেষ করে পশ্চিমারা উপনিবেশ কবলিত দেশগুলোর ওপর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালানোর কারণে তারা নিরূপায় হয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি, তাদের বোধ ও বিশ্বাসগুলোকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়ে যায়। পশ্চিমাদের নতুন চিন্তাধারায় যেহেতু রাজনীতির সাথে দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই, সেহেতু তারা রাজনৈতিক অঙ্গনগুলো থেকে ঐশী দ্বীনকে পৃথক করার জন্যে কিংবা হস্তক্ষেপ সংকুচিত করার জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল আর সেগুলোর পরিবর্তে সেক্যুলারিজমের শিক্ষাগুলোকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এই বিশ্বাসের বিস্তার ঘটিয়েছে যে, ধর্ম বা দ্বীন রাজনীতি থেকে আলাদা অর্থাৎ রাজনীতির সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তার মানে দাঁড়ায় ধর্ম এবং রাজনীতি উভয়ের গতিপথ আলাদা, উভয়েরই আওতাভুক্ত বিষয়বস্তু সুনির্দিষ্ট।

ল্যাটিন ভাষার শব্দ সেক্যুলারের অর্থ হচ্ছে আখেরাতের বিপরীতে পার্থিব এই বিশ্বের বিধি-বিধান। খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতকে এই শব্দটি খ্রিষ্টান ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতাদের মধ্য থেকে যারা বৈরাগ্য জীবন অর্থাৎ সন্ন্যাসী জীবন ত্যাগ করেছে তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে মুসলিম বিশ্বে এই সেক্যুলারিজম শব্দটি প্রবেশ করার ফলে ফার্সি, তুর্কি এবং আরবি ভাষায় এই শব্দটির বহু প্রতিশব্দ তৈরি হয়ে যায়। ফার্সি ভাষায় সেক্যুলারিজম শব্দটির জন্যে পার্থিব জগত পূজা, দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়া, রাজনীতি থেকে দ্বীনকে পৃথক করা ইত্যাদি প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।  কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে মুসলিম দেশগুলোতে সেক্যুলারিজমের প্রবেশের ঘটনা কয়েক শতাব্দি আগে ঘটেছে। সতেরো শতকে উপনিবেশবাদীদের আগ্রাসনের সূচনালগ্নে বিশেষ করে ভারতের ওপর আধিপত্য বিস্তারের সময় কিংবা বলা যায় ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে ন্যাপোলিয়নের আগ্রাসনকালে মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজম প্রবেশ করে।  

অন্যভাবে বলা যেতে পারে, বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন সেক্যুলারিজম বিদেশীদের একটা আবিষ্কার এবং এটা মুসলিম দেশগুলোতে আমদানীকৃত বা বাইরে থেকে আসা একটা মতবাদ। কেননা এই মতবাদে ধর্ম সম্পর্কে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা করা হয়েছে, ইসলাম কখনোই তা করে নি, যেমন সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এমনকি দেশ পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলাম কখনোই নিরুৎসাহিত করে নি বরং দিক-নির্দেশনামূলক শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বাহ্যতঃ মিশরে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুহাম্মাদ আলি পাশার হুকুমাতের সময় আরব বিশ্বে এই সেক্যুলারিজমের সূচনা হয়েছে বলে মনে করা হয়। কেননা পাশা জনগণের জন্যে যেসব আইন কানুন প্রণয়ন করেছে সেগুলো পশ্চিমাদের নীতিমালা অনুসরণ করেই করেছে। ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়ার মতো অন্যান্য আরব দেশও মিশরের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

অপরদিকে দীর্ঘ সময় ধরে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানী সাম্রাজ্যের পতন হলে সেক্যুলারিজমের বিস্তারের পথ সুগম হয়ে পড়ে। অথচ ইতোপূর্বে ওসমানী সাম্রাজ্যে দ্বীনকে রাজনীতি থেকে পৃথক করার চিন্তাও করা যেত না। ওসমানী খেলাফতের সাথে আরব বিশ্বের ব্যাপক সমস্যার কারণে আরবরা এই পতনের ঘটনায় সন্তুষ্ট হয়েছিল। এমনকি মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে চলমান অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে আরবরা সহযোগিতাও করেছিল। মোস্তফা কামালসহ বিরোধী পক্ষ চাইতো খেলাফত থেকে রাজতন্ত্র আলাদা হয়ে যাক এবং তুরস্ক একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হোক। এই লক্ষ্যে তিনি আরব জাতীয়তাবাদী এবং পশ্চিমা সরকারগুলোর সহযোগিতায় এবং তার পাশাপাশি ওসমানী সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সরকারের দুর্বলতার কারণে ওসমানী খেলাফতের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেক্যুলারিজম সেখানে শেকড় গেড়ে বসার উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পায়। তিনি তুরস্কের বহু ধর্মীয় মাদ্রাসা বন্ধ করে দেন, ইসলামী বিধি বিধানগুলো বাদ দেন এবং সেসবের স্থানে পশ্চিমা নিয়মনীতি প্রবর্তন করেন। তিনি এমনকি ধর্মকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে মহান বাধা বলে মনে করতেন।

ইরানের ভেতরেও সেক্যুলারিজমের আবির্ভাব খুব সহজ ছিল না, অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সেক্যুলারিজমের প্রবেশ ঘটে। ইরানে সেক্যুলারিজমের স্বর্ণযুগ হিসেবে সম্ভবত রেজা খানের সময়কালকে ধরা যায়। কেননা রেজা খান আতাতুর্ককে তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রেজা খান কেবল ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধেই যে লেগেছিলেন কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে যে আলেম সমাজকে বাদ দিয়েছিলেন তাই নয়, বরং দ্বীনকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। হিজাবসহ ইসলামের সামাজিক নীতি ও আচার এমনকি ধর্মীয় আজাদারির অনুষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে পর্যন্ত উঠেপড়ে লেগেছিলেন।

“মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো বর্তমানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের লিবারেল ডেমোক্রেসি এবং সেক্যুলারিজম মতবাদের বিস্তার ঘটাতে। এগুলোর বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে অন্যান্য সমাজের দ্বীনী বিশ্বাসগুলোতে রূপান্তর আনতে চায় পাশ্চাত্য। লক্ষ্য হলো পশ্চিমা চিন্তাদর্শের বাইরে যেসব ধর্মবিশ্বাস বা মতবাদের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করানো। কিন্তু ইসলামী দ্বীন সেক্যুলারিজমের বিশ্বাসের বিপরীতে রাষ্ট্র এবং সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।”

ইসলামের বিরুদ্ধে আরো দুটি মতবাদ ছিল হিউম্যানিজম এবং ন্যাশনালিজম। এই দুটি মতবাদও গভীর অর্থে দ্বীন এবং স্রষ্টা বিরোধী। এভাবে শিল্প বিপ্লব এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে পাশ্চাত্যের জনগণ পুরোপুরিই দ্বীন এবং দ্বীনী নীতিমালা আচার-প্রথা থেকে দূর সরে যায়। যার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বীনের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। তবু আজো টিকে আছে ইসলাম, টিকে আছে দ্বীন এবং মুসলমানদের সরব উপস্থিতি।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/  ১৮