জুলাই ২৫, ২০১৮ ২০:০১ Asia/Dhaka

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা আল আহযাবের ৩৯ থেকে ৪২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا (39)

“সেই নবীগণ আল্লাহর পয়গাম প্রচার করতেন ও তাঁকে ভয় করতেন। তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতেন না। হিসাব গ্রহণের জন্যে আল্লাহ যথেষ্ট।” (৩৩:৩৯)

গত আসরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)’র পালকপুত্র জেইদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সঙ্গে এই মহামানবের বিবাহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল যেন তাঁর নির্দেশ পরিপন্থি জনমত বা লোকলজ্জাকে আমলে না নেন। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: সব ধরনের ভয়-ভীতি ও আশঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে রিসালাতের দায়িত্ব জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়াই হচ্ছে নবী-রাসূলদের দায়িত্ব। তাঁরা শুধু আল্লাহ তায়ালাকে ভয় পাবেন এবং অন্য কোনো শঙ্কাকে মনে স্থান দেবেন না। সমাজে প্রচলিত ভুল রীতি বা জনগণের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধাচরণ করলে স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো মানুষকে হুমকি-ধমকি ও অপমানজনক আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। এ কারণে অনেক মানুষ ভুল ও অন্যায় হচ্ছে জেনেও লোকলজ্জা এবং তাদের কথার ভয়ে নিজের বিবেক-বুদ্ধির বিপরীত কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু নবী-রাসূলগণ  ও প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিরা হচ্ছেন এর ব্যতিক্রম। তারা যেকোনো কাজ করার ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করেন এবং কারো কটুকথাকে গ্রাহ্য করেন না। কারণ, তারা নিশ্চিতভাবে জানেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের সাহায্যের জন্য যথেষ্ট।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. দ্বীন প্রচারের জন্য তাকওয়া, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, সাহস ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। যার মধ্যে এ গুণগুলো নেই তার পক্ষে দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব নয়।

২. ঈমানদার ব্যক্তিরা দ্বীনের হেফাজত, প্রচার ও প্রসারে যে কষ্ট সহ্য করেন তার পুরস্কার আল্লাহর দরবারে সংরক্ষিত রয়েছে।

 সূরা আহযাবের ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

  مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا (40)

“মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।” (৩৩:৪০)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে জাহেলি যুগের একটি প্রচলিত ভুল ধারণা প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে: হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জেইদের আসল পিতা নন। কাজেই ইসলামি শরীয়ত অনুযায়ী, যেকোনো পুরুষ তার পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে; যদিও জাহেলি যুগে এ বিষয়টিকে ঘৃণ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

এই আয়াতে মুমিনদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: তোমরা রাসূলুল্লাহ  (সা.)কে নিজেদের মতো ভেবো না। তোমাদের যেমন অনেক সন্তান-সন্ততি রয়েছে এবং তাদের প্রয়োজন পূরণকে তোমরা নিজেদের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করে আল্লাহর রাসূল তেমন নন। তোমরা যেকোন কাজ করার ক্ষেত্রে সন্তানদের প্রতি ভালোবাসায় আপ্লুত হও এবং সন্তানবাৎসল্যের কারণে অনেক সময় অন্যায় কাজও করে বসো। কিন্তু আল্লাহর রাসূল তেমন নন বরং তিনি একটি উম্মতের পিতা এবং এই গোটা উম্মতের সুখ-সমৃদ্ধির কথা তাঁকে চিন্তা করতে হয়।  কেয়ামত পর্যন্ত এই উম্মত যেন দ্বীনের পথে অটল থেকে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করে সেই প্রচেষ্টায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন।

এরপর আমাদের রাসূল যে শেষ নবী সে বিষয়ের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে: সমস্ত নবী-রাসূলদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তিনি একইসঙ্গে আল্লাহর নবী এবং শেষ রাসূল। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং মানবজীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গতম দ্বীনি শিক্ষা তাঁর মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছেছে।

এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১. মানবজাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম হচ্ছে শেষ ঐশী ধর্ম এবং কুরআন মজিদ শেষ ঐশী কিতাব।

২. মহান আল্লাহর অসীম জ্ঞানের আলোকে শেষ নবীর মাধ্যমে রিসালাতের পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ভালো করে জানেন, এই রাসূলকে অনুসরণের মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবে।

সূরা আহযাবের ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا (41) وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا (42)

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।” (৩৩:৪১) 

“এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা (ও মহিমা) বর্ণনা করো।” (৩৩:৪২)

এই আয়াতে মুমিন ব্যক্তিদেরকে সব সময়- সব অবস্থায় আল্লাহর জিকির করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ, মানুষকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় আল্লাহকে ভুলে গিয়ে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার মতো অসংখ্য উপাদানের মুখোমুখি হতে হয়। মানুষকে যেমন তার নফস বা কুপ্রবৃত্তি ধোঁকা দিতে পারে তেমনি তার পক্ষে শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং দুষ্ট লোকের পাল্লায় পড়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কাজেই মানুষের সামনে থাকা এই বহুমুখী বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বদা আল্লাহর স্মরণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।  আল্লাহ তায়ালার এই নির্দেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই আমরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। তবে এই আয়াতে আল্লাহকে স্মরণ করতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেজন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ই যথেষ্ট নয়। একজন মুমিন মুসলমানকে প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি কাজে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে।

যেকোনো কাজ করতে গেলে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে- এই কাজটি আল্লাহর নির্দেশিত পথে হচ্ছে কি? যদি ইতিবাচক উত্তর আসে তাহলে তা করতে হবে এবং নেতিবাচক উত্তর আসলে সে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এখানে নিজের মনের কামনা-বাসনাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। সব সময় আল্লাহর স্মরণের অর্থ হচ্ছে তাঁর দেয়া যেকোনো নেয়ামত ব্যবহারের সময় শুকরিয়া আদায় করা এবং যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি ও বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ করা। গোনাহ বা পাপকাজের মুখোমুখি হলে আল্লাহ তায়ালার ভয়ে তা করা থেকে বিরত থাকা এবং গোনাহ করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করার মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করা।

অবশ্য এসবের পাশাপাশি মৌখিকভাবেও আল্লাহর জিকির করার নির্দেশনা এসেছে।  মহানবী (সা.) নিজ কন্যা হযরত ফাতেমা জাহরাকে এমন একটি জিকির শিখিয়ে দিয়েছেন যা প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর করতে বলা হয়েছে।  জিকিরটি হচ্ছে- ৩৩ বার সুবহানআল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. আল্লাহর জিকির বা স্মরণ শুধু মুখে উচ্চারণ করলে হবে না বরং মানুষকে প্রতিটি কথা, কাজ ও চিন্তায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।

২. আল্লাহর স্মরণ তখনই মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে যখন তা সার্বক্ষণিকভাবে করা হয়। মাঝেমধ্যে আল্লাহর স্মরণ মানুষকে সুফল দিতে সক্ষম নয়।#