জানুয়ারি ০৩, ২০১২ ০৯:৩৮ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসিরবিষয়ক অনুষ্ঠান 'কুরআনের আলো'র আজকের পর্বে সূরা আল-বাকারাহ'র ২০ থেকে ২২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২০ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:

يَكَادُ الْبَرْقُ يَخْطَفُ أَبْصَارَهُمْ كُلَّمَا أَضَاءَ لَهُمْ مَشَوْا فِيهِ وَإِذَا أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُوا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (20

"বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। আসমানের বিদ্যুৎ যখন অন্ধকার প্রান্তরে তাদের জন্য আলো নিয়ে আসে, তখন তারা কয়েক কদম অগ্রসর হয়। কিন্তু যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন তারা থমকে দাঁড়ায়। আল্লাহ চাইলে তাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।" (২:২০)

আকাশের বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাতের শব্দ বৃষ্টির আলামত। এ হলো পৃথিবীবাসীদের জন্য নবপ্রাণ, সবুজ ও সজীবতার আগমনী বার্তা। কিন্তু এই আগমনী বার্তা সবার জন্য সুসংবাদ নয়। বরং তাদের জন্য শুভবার্তা যারা আল্লাহর এই রহমত থেকে উপকৃত হতে প্রস্তুত। তাহলে ওই উদ্ভ্রান্ত যাত্রীর কি অবস্থা হবে? উদ্ভ্রান্ত যাত্রী বা মুনাফিক অন্ধকার প্রান্তরে যে আগুন জ্বালিয়েছে তার দুর্বল আলো এবং আকাশের বিদ্যুৎ চমকানির চোখ ধাঁধাঁনো আলোর কোনটাই তাকে জীবন চলার পথে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারবে না। কারণ আগুনের আলো হলো অস্থায়ী, আর বিদ্যুৎ চমকের ফলে যে আলো সৃষ্টি হয় তা বৃষ্টির বার্তা বয়ে আনে এবং এতে মুনাফিকদের জন্য দুঃখ ছাড়া আর কিছু নেই।

আল্লাহর ওহী হলো আসমানের চোখ ধাঁধাঁনো বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। এটি দেখার সাধ্য ও ক্ষমতা মুনাফিকদের নেই। তারা পয়গম্বরদের কাছ থেকে আগত আল্লাহর ওহী থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করে না। যদিও মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে ঈমানদার হওয়ার দাবী করে এবং এই নূর থেকে উপকৃত হতে চায়। কিন্তু বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নেয়, তাদের জন্য এগুবার পথ বন্ধ করে দেয়। কোরআন মুনাফিকদের মুখোশ এমনভাবে খুলে দেয় যে তারা আর ঈমানদারদের সাথে পথ চলা অব্যাহত রাখতে পারে না। সামনের দিকে যাওয়ার যেমন তাদের কোন পথ থাকে না, তেমনি পিছু হটারও কোন উপায় থাকেনা। তারা পথ হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত উদ্বেগ উত্তেজনায় পথ হাতড়াতে থাকে। এসব হলো আল্লাহ এবং মুমিনদের সাথে কপটতার দুনিয়াবী ফল। আল্লাহ যদি তাদেরকে শাস্তি দিতে চান তাহলে তারা শুধু চলার শক্তিই হারাবে না একই সাথে দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তিও হারিয়ে বসবে।

সূরা বাকারাহ'র ২০ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত: আল্লাহর নূর দেখার শক্তি মুনাফিকদের নেই। আল্লাহর বাণী আকাশের বিদ্যুৎ চমকের মত তাদের দৃষ্টি শক্তি হরণ করে নেয়।

দ্বিতীয়ত: মুনাফিকদের নিজস্ব কোন আলো নেই তাই তারা মুমিনদের আলোয় পথ চলার চেষ্টা করে।

তৃতীয়ত: মুনাফিকরা অনেক সময় কয়েক কদম অগ্রসর হলেও মূলতঃ অগ্রসর হতে পারে না এবং অবশেষে থমকে দাঁড়ায়।

চতুর্থত: মুনাফিকরা তাদের অপকর্মের কারণে যেকোনো সময় আল্লাহর গজবের শিকার হতে পারে। তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে পারবে না এবং আল্লাহর শাস্তি থেকেও পালাতে পারবে না। কারণ আল্লহপাক সর্বশক্তিমান এবং কোন কাজই তার অসাধ্য নয়।

এরপর এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (21

"হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের এবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী ও পরহেজগার হও।" (২:২১)

সূরা বাকারাহ'র প্রথম ২০ আয়াতে আল্লাহপাক তিন শ্রেণীর মানুষের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এই তিন শ্রেণী হলো-পরহেজগার, কাফের ও মুনাফিক। এই তিন শ্রেণীর লোকদের বৈশিষ্ট্য, চিন্তাধারা ও আচরণ তুলনা করার পর এই আয়াতে কল্যাণ ও মুক্তির পথনির্দেশ করে বলা হয়েছে- প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এবং তাকওয়া বা খোদাভীরুতার অধিকারী হওয়ার জন্য কেবল একটি পথ রয়েছে। আর তা হলো সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর প্রতি আসক্ত হওয়া, যে আল্লাহ আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অন্যদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একমাত্র তারই দাসত্ব করতে হবে। এমন অনেক মানুষ আছে যারা আল্লাহকে বিশ্ব জগত ও মানুষের স্রষ্টা বলে স্বীকার করে, কিন্তু নিজের ও সমাজ জীবনের দিকনির্দেশনা ও জীবনাদর্শ গ্রহণ করে অন্যদের কাছ থেকে। যেন আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন আর তারা তাদের খুশীমত চলবে।

এই আয়াতে এ ধরনের চিন্তা-ভাবনার জবাবে বলা হয়েছে- "তোমাদের স্রষ্টা, তোমাদের প্রতিপালকও বটে। তোমাদের বিকাশ ও বেড়ে ওঠার জন্য তিনি কিছু দায়িত্ব ও কর্মসূচী নির্ধারণ করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা ও ব্যবস্থা ঠিক করে দিয়েছেন। আইন ও বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর যিনি কিনা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।" অতএব একমাত্র তারই উপাসনা করতে হবে, তার আনুগত্য করতে হবে এবং তার দেয়া বিধান মেনে চলতে হবে। স্রষ্টা ও প্রতিপালকের আনুগত্য এবং তার দেয়া আইন মেনে চললে মানুষেরই লাভ। এর ফলে মানুষ মন্দ ও অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবে এবং উত্তম ও কল্যাণের অধিকারী হবে।

এই আয়াতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে- সত্য ও কল্যাণের দিকে পয়গম্বরদের আহ্বান সার্বজনীন। এই আহ্বান কোন বিশেষ শ্রেণী, জাতি বা গোত্রের জন্য নির্ধারিত নয়। তাই পবিত্র কোরআনে প্রায় ২০ বার সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে- "ইয়া আইয়ুহান্নাস"। আল্লাহর এবাদত ও উপাসনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আমাদের প্রতি এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি আল্লাহপাকের অশেষ নেয়ামতের প্রতি শোকর আদায় করা। এটা মনে রাখতে হবে যে আমাদের এবাদত-বন্দেগী ও উপাসনার কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। আমাদের নামাজ-রোজা ও অন্যান্য এবাদত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বকে বৃদ্ধি বা হ্রাস করে না। বরং নিজেদের বিকাশ ও পূর্ণতার জন্যেই আমাদেরকে তার এবাদত করতে হবে এবং তাঁর পূর্ণ অনুগত থাকতে হবে।

এরপর ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (22

"যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ এসব তোমরা জান।" (২:২২)

এ আয়াতে আল্লাহপাক বেশ কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, যে নেয়ামতগুলো আবার অন্য বেশ কিছু নেয়ামতের উৎস। আল্লাহ পৃথিবীকে মানুষের জন্য বিছানার মত করে সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীর পাহাড় প্রান্তর, মাটি, পানি, মাটির ওপর ও ভেতরকার হরেক রকমের খনিজ ও প্রাকৃতিক দ্রব্য সব কিছু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য উত্তম ব্যবস্থায় সৃষ্টি করেছে। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে চমৎকার সমন্বয়ের ফলে বৃষ্টি ঝরে পড়ে, বেড়ে ওঠে গাছ-পালা, ফল-মূল। এভাবে মানুষ খাদ্য ও জীবিকা লাভ করে। এ সব কিছুই সংঘটিত হয় আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার বলে। তাই অন্যরা যখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল তখন কিভাবে তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বিবেচনা করবো? কি করে আল্লাহর নির্দেশ বাদ দিয়ে তাদের নির্দেশ মানা সম্ভব?

এই আয়াতের মূল কথা হচ্ছে, আল্লাহকে চেনা, তাঁর আনুগত্য করা এবং আল্লাহর এবাদতের সর্বোত্তম উপায় হলো তাঁর নেয়ামতের প্রতি লক্ষ্য করা। তাই এর আগের আয়াতে আল্লাহর উপাসনার নির্দেশ দেয়ার পর এ আয়াতে মানুষের প্রতি আল্লাহর কিছু নেয়ামতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার চমৎকার সমন্বয় ও শৃংখলা হলো এক মহা ক্ষমতাবান ও জ্ঞানী স্রষ্টার অস্তিত্বের সেরা দলিল।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়- আল্লাহপাক সৃষ্টি জগতকে মানব জাতির জন্য সৃষ্টি করেছেন। অন্য সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। সৃষ্টি জগতের প্রত্যেক অংশের মধ্যে বিরাজমান সমন্বয় ও শৃংখলা থেকে এক খোদার অস্তিত্ব বোঝা যায়। এ দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে হতে হবে একত্ববাদী এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করানো চলবে না।#

ট্যাগ