অক্টোবর ২৪, ২০১৮ ১৬:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: ইয়াজদের ‘মেইবোদ’ শহর

ইয়াজদের এই ছোট্ট শহরটি প্রাদেশিক বাণিজ্যের জন্য দ্বিতীয় প্রধান শহর হিসেবে খ্যাত।

মফস্বল শহর মেইবোদের আয়তন ১২ হাজার ৭১ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে ইয়াযদ শহরের পরই মেইবোদের অবস্থান। ঐতিহাসিক মেইবোদ হচ্ছে এই মফস্বল শহরের কেন্দ্রীয় শহরের নাম। মেইবোদের লোকজনের ভাষা হচ্ছে ফার্সি। তবে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট একেকটা ঢং আছে। প্রাচীনকাল থেকেই মেইবোদে কৃষিকাজের রেওয়াজ ছিল। বলাবাহুল্য এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান কাজই ছিল কৃষিকাজ। তবে শহরের আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় আনারের চাষও হতো এবং এখনো হচ্ছে। শহরের বাইরের ভূখণ্ডে অবশ্য গম, পেস্তা বাদাম, তুলাসহ শসা, বেগুনি ধরনের বিচিত্র তরিতরকারির চাষ হয়। মেইবোদে পশুপালনও করা হয়। মফস্বল এলাকার পশ্চিম দিকে একেবারে পর্বতের পাদদেশে পশুপালনের রেওয়াজ সবচেয়ে বেশি। মেইবোদে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় শতরঞ্জি এবং হাতে তৈরি মৃৎ শিল্প। এসবের বাইরেও সিরামিক উৎপাদনের জন্য ইরানের মধ্যে বিখ্যাত এই শহর। 

মেইবোদ শহরটি ইরানের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অনন্য সাধারণ একটি শহরের প্রতীক। শহরটি যদিও ব্যাপক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আসতে ঐতিহ্যবাহী অস্তিত্বের অনেকটাই হারিয়েছে তারপরও প্রাচীন শহরের উপাদান যেমন পুরনো রাস্তাঘাট, প্রাচীন অনেক স্থাপনা ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষের নমুনা এখনও দেখতে পাওয়া যাবে। বহু মসজিদ, প্রাচীন অনেক কেল্লা, সরাইখানা, প্রাকৃতিক হিমাগার, পানির আধার যেগুলো এখনও মেইবোদে দেখতে যায় সেগুলোই এই শহরের প্রাচীনত্বের প্রমাণ বহন করে। আমরা বরং বর্ণনার জগত থেকে বাস্তব জগতে ফিরে গিয়ে দেখেই আসি মেইবোদের এইসব ঐতিহাসিক নিদর্শন। 

‘মেইবোদ জামে মসজিদ’ মেইবোদ শহরের ইসলামী শাসনামলের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোর একটি। অবস্থানগত দিক থেকে এই মসজিদটি মেইবোদ শহরের ঠিক কেন্দ্রে পড়েছে। জামে মসজিদকে তাই শহরের প্রাণ বলে মনে করা হয়। পুরো শহরের সাথে এই মসজিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। বাজারঘাটের সাথে যেমন তেমনি শহরের প্রবেশপথগুলোর সাথেও। মেইবোদ জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের আয়তন প্রায় তিন হাজার বর্গমিটার। পুরো কম্পাউন্ডে কয়েকটি মসজিদ আছে ছোটো ছোটো, একটির সাথে একটি লাগোয়া হলেও সবকটাই পৃথক। তবে মূল মসজিদের বিশাল একটি উঠোন আছে। পুরো একটা ঘরের ওপর বিরাট গম্বুজ রয়েছে, রয়েছে ঝুল বারান্দা। পামেই রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার উপযুক্ত খোলা জায়গা। সাধারণত গরমের সময় এই জায়গাটি বেশি ব্যবহৃত হয়। ফার্সি ভাষায় মসজিদের ছাদযুক্ত এই খোলা আঙ্গিনাকে বলা হয় ‘শাবেস্তান’। 

উল্টো আয়োজনও রয়েছে মসজিদে। মসজিদের উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে ‘উষ্ণাগার’ রয়েছে। এগুলো একেকটি রুমের মতো দেখতে। রুমের ভেতর গরম বা উষ্ণতা সৃষ্টির ব্যবস্থা রয়েছে। শীতকালীন শাবেস্তান হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই রুমগুলো। মেইবোদ জামে মসজিদের আরো স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ইমাম হোসাইন মসজিদ। রয়েছে হাজি হাসান আলি মসজিদ। মসজিদ কমপ্লেক্সের সাথে সংযুক্ত অপরাপর স্থাপনার মধ্যে ছিল সরাইখানা এবং জলাধার। ‘ছিল’ বলার কারণ হলো এগুলোর অস্তিত্ব এখন আর একেবারেই নেই। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কালাতিক্রমে। 

‘নরিন কেল্লা’র নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ইয়াযদ ভূখণ্ডে শহর বা নগর নির্মাণের সূত্রপাত এই কেল্লার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে বলে ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ থেকে জানা যায়। তার মানে মেইবোদের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা হলো নরিন কেল্লা। বরং বলা যেতে পারে কাঁচা বা রোদে পোড়া ইটের তৈরি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অন্যতম এই কেল্লাটি। তা কেবল ইয়াজদের মধ্যেই নয় বরং সমগ্র ইরানের মধ্যেই ইসলামপূর্ব কালের স্থাপনার ইতিহাসে এটাই সর্বপ্রাচীন স্থাপনা। পুরাতত্ত্ববিদদের পক্ষ থেকে সর্বশেষ যে গবেষণামূলক খননকাজ চালানো হয়েছে এখানে, তা থেকে প্রমাণিত হয়েছে এই কেল্লাটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের একটি স্থাপনা। অর্থাৎ এখন পাঁচ হাজার বছরেরও আগের স্থাপনা এটি।

মেইবোদের নরিন কেল্লা শহরের সবোর্চ্চ এলাকার ওপরে চার হেক্টর ভূমির ওপর স্থাপন করা হয়েছে। ভেতরের স্থাপত্য ডিজাইন একেবারেই অন্যরকম। প্রতিরক্ষার দিকটি মাথায় রেখেই এরকম ব্যতিক্রমী করে তৈরি করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ভেতরকার বর্ণনা দিয়ে বোঝানো মুশকিল।

‘শাহ আব্বাসি সরাইখানা’ মেইবোদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। এই সরাইখানার যে কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা সাফাভি যুগের স্থাপত্য ডিজাইনের সাথে মিলে যায়। পথিমধ্যে কাফেলার বিশ্রাম কিংবা যাত্রাবিরতির জন্য যা যা থাকা লাগে সবকিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে এই সরাইখানায়। চার ঝুলবারান্দা বিশিষ্ট ইটের তৈরি স্থাপনা এটি। সরাইখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন রয়েছে তেমনি পানিসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর সুব্যবস্থা রয়েছে। শুধু রয়েছে বললে ভুল হবে বরং এ অঞ্চলের মধ্যে এ ধরনের সরাইখানার উদাহরণ আর একটিও নেই।

শাহ আব্বাসি সরাইখানার ঠিক সামনেই রয়েছে আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি হলো প্রাচীন একটি জলাধার। এর নাম হলো ‘কালর’। সরাইখানায় প্রবেশ করার জন্য যে পথটি রয়েছে তার ঠিক বিপরীত দিকে জলাধারটি অবস্থিত। জলাধারের কারণে সরাইখানার সৌন্দর্যও বহুগুণ বেড়ে গেছে। প্রস্তর লিখন অনুযায়ী খ্রিষ্টীয় এক হাজার ৭০ সালে জলাধারটি নির্মাণ করা হয়েছে। জনস্বার্থের কথা মাথায় রেখেই স্থপতিরা এই জলাধারটি তৈরি করেছেন। এর পানিও বিশুদ্ধ এবং সুপেয় বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ২৪

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ