ডিসেম্বর ১২, ২০১৮ ২২:১৫ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার:  ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরমানশাহ

কেরমানশাহ প্রদেশটি ইরানের অন্যতম একটি প্রাচীন শহর। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে প্রাচীন একটি কেন্দ্র হিসেবে কেরমানশাহ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ।

এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন হৃদয়স্পর্শী, তেমনি আবহাওয়াও খুবই উপভোগ্য। এ কারণে এই প্রদেশে গড়ে উঠেছে প্রচুর পর্যটন এলাকা। কেরমানশাহ প্রদেশের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে এখানে। এখানকার লোকজনের অতিথি পরায়নতার বিষয়টিও সবার মুখেমুখে উচ্চারিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকেই। এই বৈশিষ্ট্যটি ইরানের মাঝে কেরমানশাহকে দিয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি মর্যাদা। ইরানের যে ছয়টি প্রদেশ সংস্কৃতিবহুল কেরমানশাহ প্রদেশ তাদের একটি। অন্তত ৬০০ টি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে কেরমানশাহে। এসব নিদর্শন দেখার জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ দেশ বিদেশ থেকে এই প্রদেশে আসেন।

ইরান বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিচিত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালনভূমি। সেইসাথে প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেও ইরান মেসোপটেমিয়ান অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে প্রাচ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে বলা যায় ইরানে হাজার হাজার বছর ধরে যেসব সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো সমগ্র মানব জাতির জন্যেই মূল্যবান সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে। এইসব সভ্যতার মধ্যে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল থেকে দক্ষিণ পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত যাগরোস পর্বতমালা বিস্তৃত। প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য আর দুই শ’ কিলোমিটার প্রস্থ এই পর্বতমালায় রয়েছে সবুজ শ্যামল অসংখ্য উপত্যকা। প্রাচীনকাল থেকেই বিচিত্র সভ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই উপত্যকা অঞ্চলের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

এখনো এই অঞ্চলটি কয়েকটি দিক থেকে বেশ মূল্যবান। একদিকে এখানে যেসব বনজঙ্গল রয়েছে সেসব বনে আখরোট, বাদামের মতো বিচিত্র ফলফলাদি উৎপন্ন হয়, অপরদিকে এগুলোর রয়েছে প্রতিরক্ষা মূল্যও। যুদ্ধবিগ্রহে এসব জঙ্গল এবং উপত্যকা কৌশল নির্ধারণেও সহযোগিতা করে। বিস্তীর্ণ অনেক চারণভূমি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আবাসিক এলাকাও। চারণভূমিগুলো পশুপালন করার জন্য বেশ উপযোগী একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় এই কেরমানশাহ প্রদেশে তাই যুগে যুগে জন্ম হয়েছে বহু সভ্যতা। এসব সভ্যতার পাশাপাশি প্রাচীন এইলামি এবং মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার কথাও ইতিহাসে পাওয়া যায়। পুরাতত্ত্ব গবেষকদের গবেষণা থেকে পাওয়া বিশেষ করে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল।

কেরমানশাহ প্রদেশের আয়তন ২৪ হাজার চার শ ৩৪ বর্গকিলোমিটার। কেরমানশাহ প্রদেশের উত্তরে রয়েছে কুর্দিস্তান প্রদেশ, পূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব দিকে রয়েছে হামেদান প্রদেশ, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রয়েছে ইরাক আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে এইলাম এবং লোরেস্তান প্রদেশ। প্রদেশটি পার্বত্য এলাকা বেষ্টিত। ইরান এবং মেসোপটেমিয়ান অঞ্চলের মাঝামাঝিতে পড়েছে। যেদিকেই তাকানো যাবে দেখা যাবে পর্বতচূড়া আর উঁচুনিচু অসংখ্য টিলা। কেরমানশাহ প্রদেশের আবহাওয়া দু ধরনের-ঠাণ্ডা আবহাওয়া অঞ্চল এবং গরম আবহাওয়া অঞ্চল। প্রদেশটির গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বারো শ’ মিটার। কেরমানশাহ প্রদেশে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ হচ্ছে পাঁচ শ’ মিলিমিটার। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পাহাড় হলো পারাভ, দলা’হু, বিস্তুন এবং বজিদারজ। পুরো প্রদেশে কেন্দ্রীয় শহর কেরমানশাহ ছাড়াও রয়েছে ১৪টি উপশহর।

এই প্রদেশে খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক সহস্রাব্দ আগে থেকেই মানব বসতি গড়ে উঠেছে। আকিদ বাদশাহির প্রতিষ্ঠাতা সরগেনে’র নিদর্শনগুলোর মাঝে যাগরোসের জনগণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সরগেন রাজবংশীয়রা খ্রিষ্টপূর্ব ২০৩০ থেকে ২০৪৮ সাল পর্যন্ত বাদশাহী করেছিল। ইরানের প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত কেরমানশাহ প্রদেশ ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে রাজনৈতিক বহু চড়াই উৎরাই প্রত্যক্ষ করেছে। অবস্থানগত এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণেই এতো বেশি উত্থান-পতন দেখেছে প্রদেশটি। বলা হয়ে থাকে পিশদাদিয়ানের রূপকথার রাজা তাহমোরেস দেওবান্দ কেরমানশাহকে নির্মাণ করেছেন। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন সাসানি বাদশাহ বাহরামের হাতেই গড়ে উঠেছে কেরমানশাহ।

মাদ রাজবংশীয় বাদশাহরা এই এলাকায় বেশ ভালোভাবেই শেকড় গেড়েছে। অ্যালেক্সান্ডারের সময়কার ইতিহাসবিদরা এ এলাকার বেশ কয়েকটি শহরের নাম উল্লেখ করেছেন। শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে কালায়াযাগরি, সারপুল জাহব, করিনা, কাঙ্কুইয়া ইত্যাদি।

সাসানীয় শাসনামলে ইরানের পশ্চিম উপকণ্ঠ বিশেষ করে কেরমানশাহ শহরের ওপর এই রাজবংশীয়দের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। সে সময়কার রাজধানী তিসফুনের কাছাকাছি অবস্থানে থাকার কারণে গ্রীষ্মের অসহনীয় প্রচণ্ড গরমের সময় বাদশারা কেরমানশাহের গ্রামীণ পরিবেশে গড়ে তোলা প্রাসাদগুলোতে কাটাতো। প্রথম কোব্বাদ এবং আনুশিরভান সাসানীর সময় এই শহরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। এটা খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিককার কথা।

ইসলামী ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন আনুশিরভান যখন বাদশাহ ছিলেন তখন রাম এবং চীন থেকে যেসব রাষ্ট্রীয় অতিথি বা আধুনিককালের রাষ্ট্রদূতগণ ইরান সফরে আসতেন তাঁদেরকে তিনি এখানকার প্রাসাদেই অভ্যর্থনা জানাতেন। তাঁদের লেখা থেকে জানা যায় বিশ্বপর্যটক মাসআর বিন মুহালহাল হিজরি চতুর্থ শতকে কেরমানশাহ সফর করেছেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে কেরমানশাহের ‘ত্বকবোস্তন’ নামক প্রাচীন স্থাপনাটির উল্লেখ করেছেন। একই শতাব্দীতে ইবনে হোকালও কেরমানশাহ শহরের কথা লিখেছেন। তিনি এই শহরটিকে অত্যন্ত পরিপাটি, সুন্দর, সবুজ গাছগাছালিপূর্ণ, ঝর্ণাপ্রবাহময় একটি শহর বলে উল্লেখ করেছেন। এই শহরের জনগণ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন বলেও জানিয়েছেন।

শাহ ইসমাইল সাফাভির শাসনকালে সুলতান মুরাদ কাভিয়ানলু ৭০ হাজার লোক নিয়ে কেরমানশাহ এবং হামেদান শহর দখল করে। এরপর ওসমানী সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ ঢেকাতে সাফাভিরা এই শহরটির প্রতি নজর দেয়। শেখ আলি খান যাঙ্গানের সময় কেরমানশাহ জাঁকজমকপূর্ণ একটি শহরে পরিণত হয়। কিন্তু আফসারিয়ের সময় ওসমানিয়রা ঠিকই আক্রমণ চালায় তবে নাদের শাহের বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বের কারণে ওসমানিয়রা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। নাদের শাহের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ওসমানিয়রা এই শহর দখলের জন্য বহুবার চেষ্টা চালায়। এ কারণে কেরমানশাহ যুগে যুগে বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হিজরি ১২৬৭ সালে নাসের উদ্দিন শাহ কাজারের পক্ষ থেকে কেরমানশাহ শাসনের ভার ইমাম কুলি মির্যার ওপর ন্যস্ত করা হয়। তিনি ২৫ বছর এই শহর শাসন করেন এবং তাঁর সময়ই কেরমানশাহ শহরের বিচিত্র উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ১২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ