নভেম্বর ১৫, ২০১৮ ১৬:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: যানজন প্রদেশের  কাপের্ট বোনা শিল্প

যানজন প্রদেশে প্রাচীন মসজিদ, ভবন, হাম্মাম, পানির হাউজের মতো ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন রয়েছে দেখার মতো।

একটি আসরে তো আর এতোগুলো নিদর্শন নিয়ে কথা বলার মতো সুযোগ নেই, তাই আমরা এগুলোর মধ্য থেকে ঐতিহাসিক ‘রাখ্‌তশুয়ি খানা’ নিয়ে এ আসরে এ সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আসরের শেষদিকে যানজনের হস্তশিল্পের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। ‘রাখ্‌তশুয়ি খানা’ বাংলায় দাঁড়াবে ধোপাখানা অর্থাৎ ধোলাই বা লন্ড্রি ঘর। যানজন শহরের প্রাচীন এলাকায় পড়েছে এই ধোপাখানা। এই ধোপাখানাটি বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই নিদর্শনটি যানজনের জনগণের প্রাচীন ইতিহাসি ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক, দ্বিতীয়ত, তাদের মাঝে প্রচলিত রীতি-আচারের স্মারক। দর্শনীয় এই স্থাপনাটি যিনি দেখবেন তাঁর স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে এই ধোপাখানার চিত্র। 

স্থাপত্যকলার দিক থেকে এই স্থাপনাটির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ব্যবহারিক বা কার্যকারিতার দিক থেকেও সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। আনুমানিক নব্বুই বছর আগে এই স্থাপনাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে চমৎকার কমপ্লেক্স। সে সময়কার যানজনের নগর মেয়র মরহুম আলি আকবর তৌফিকির উদ্যোগে চমৎকার এই পরিবেশটি গড়ে তোলা হয়েছে। সমকালীন দুইজন বিখ্যাত স্থপতি এগুলো নির্মাণ করেন। মানুষ তথা সর্বসাধারণ যেন খুব সহজে এবং নিরাপদে তাদের পোশাক আশাক ধু’তে পারে সেজন্যই এ ব্যবস্থা। পানির হাউজ, মুক্ত আঙিনা এবং ধোয়ার উপযুক্ত পরিবেশ-এইসব নিয়েই ধোপাখানা। ধোপাখানার আঙিনা লম্বায় ২৩ মিটার আর প্রস্থে ১২ মিটার। আয়তক্ষেত্র আকারের এই আঙিনায় সুন্দরভাবে সাজিয়ে গাছ লাগানো হয়েছে। যে কারণে এই ধোপাখানা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার মধ্যে রয়েছে স্থাপত্যশৈলী এবং ডিজাইনের ক্ষেত্রে ইসলামি ও ইরানি স্টাইলের সংমিশ্রণ।

 পানির যে আধারের কথা বলছিলাম সেটি কমপ্লেক্সের উত্তর দিকে ধোপাখানার উপরের দিকে অবস্থিত। ১৭ মিটার দৈর্ঘ্য আর সাড়ে এগারো মিটার প্রস্থবিশিষ্ট পানির হাউজটির উচ্চতা আট মিটার। ভাবতেই কেমন অবাক হবার মতো ব্যাপার যে এতো উঁচুতে অবস্থিত পানির একটি হাউজ অন্তত ৭৪০ ঘনমিটার পানিতে পূর্ণ রাখা হতো। পানির হাউজের ভেতরের অঙ্গনকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। একটি অংশ হলো ‘খাযিনে’ অর্থাৎ পানির আধার। প্রাচীনকালে মির বাহাউদ্দিন খালের পানি দিয়ে এই খাযিনে পূর্ণ করা হত। দ্বিতীয় অংশে পড়বে তিনটি হাউজ। এগুলো একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া।

আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো প্রত্যেকটি হাউজই এমনভাবে বানানো হয়েছে যে একটি থেকে অন্য হাউজে পানি যাবার ব্যবস্থা রয়েছে। এই হাউগুলোর বিচিত্র ব্যবহার ছিল সে সময়। পুরো স্থাপনার ছাদে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। ওই গম্বুজে আলো প্রবেশের জন্য চমৎকার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। অনন্য এই বৈশিষ্ট্যের কারণে ধোপাখানাটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে এটি নৃতত্ত্ববিদ্যা যাদুঘর হিসেবে কৌতূহলী দর্শকদের জ্ঞানের চাহিদা মেটাচ্ছে।

যানজনের বিখ্যাত ধোপাখানা নিয়ে আলোচনা করা হল। আসরের এ পর্যায়ে আমরা যানজনের হস্তশিল্পের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো ইনশাআল্লাহ। সমগ্র যানজন প্রদেশই ইরানের হস্তশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। হস্তশিল্পের জন্য যানজন প্রদেশ কেবল এখনই নয় বরং ইতিহাসের কালপরিক্রমায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই সারাবিশ্বে ইরানের একান্ত নিজস্ব শিল্প সামগ্রীর প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। ইরানের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে এই প্রদেশের হস্তশিল্পের এতো মর্যাদার কারণ হলো যানজনের শিল্পীদের মেধা, নৈপুণ্য ও কর্মস্পৃহা। যানজনের ঘরে ঘরে যেমন এই হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি হচ্ছে তেমনি কলকারখানাও গড়ে উঠেছে অসংখ্য। শিল্প নির্মাণের এই বিস্তৃত পরিসরই প্রমাণ করছে যানজনের হস্তশিল্প সামগ্রী কতোটা জনপ্রিয়।

যানজনের জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে চালু হস্তশিল্পের মধ্যে রয়েছে সোনা-রূপার তৈরি ঝালর বোনা, কার্পেট বোনা, চামড়ার ফিতা দিয়ে তৈরি হাতে বোনা জুতা, সুতোর তৈরি হাতে বোনা জুতা, ছুরি-চাকু তৈরি, মৃৎপাত্র তৈরি, জাজিম এবং গেলিম তৈরি, তামার পাত্রের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্মসহ পশম দিয়ে তৈরি আরো বহু রকমের হস্তশিল্প। এগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি শিল্পের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।

ঝালর তৈরি ইরানের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পের একটি। ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে বিশেষ করে ইরানের শিল্পের ইতিহাসে সোনা-রূপার ঝালর তৈরির কথা পাওয়া যায়। সেইসব ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী ইরানের এই শিল্পটি হিজরি দশম শতকের বলে উল্লেখ রয়েছে। এই শিল্পটি বেশ জটিল এবং সুন্দর। সোনা রূপা গলিয়ে তারের মতো চিকন করে সেই তার দিয়ে ঝালর বানানো হয়। বেশ কয়েকটি পর্ব রয়েছে এই শিল্পটি তৈরির ক্ষেত্রে। তার তৈরির পর সাপের মতো পেঁচিয়ে ঝালর তৈরির পাশাপাশি চিনির টুকরো রাখার পাত্র, চায়ের পেয়ালা রাখার পাত্র, শরবত খাবার পাত্র, সোনারূপার অলঙ্কার রাখার পাত্রসহ এ জাতীয় আরো অনেক জিনিস তৈরি করা হত।

যানজন প্রদেশের আরেকটি হস্তশিল্প হচ্ছে কার্পেট বোনা। কার্পেট বোনার রেওয়াজ পুরো প্রদেশেই ছিল এবং এখনো আছে। পশুপালন করার কাজ যারা করেন তাদের পরে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ শিল্প হলো কার্পেট বোনা। সাধারণত মহিলারাই এই কার্পেট বোনার কাজটি করে থাকেন। ‘বিতাগনে’ যানজন প্রদেশের সবচেয়ে নামকরা কার্পেট হিসেবে পরিচিত। রঙ, নকশা, বুনন কৌশল সবদিক থেকেই এই কার্পেট বেশ উন্নতমানের। এ কারণে দেশের বাইরেও প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হয়ে থাকে যানজনের কার্পেট, বিশেষ করে জার্মানিতে বিতাগনে কার্পেট প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হয়।

চরুকদুজি শিল্পের কথা বলেছিলাম। চরুক বলতে বোঝায় নারীদের এক ধরনের জুতা। এই জুতার তলাটি চামড়ার তৈরি আর জুতার উপরের ভাগ সুতার তৈরি। বিভিন্ন সূতা দিয়ে তৈরি হয় চরুক। অনেক সময় সিল্কের সূতা দিয়েও চরুক তৈরি করা হত।

হস্তশিল্প সামগ্রীর বাইরে যানজনে প্রাকৃতিক কিছু নিদর্শনও রয়েছে। এদের একটি হলো ‘কাতলে খোর’ গুহা। বহু প্রাচীন এই গুহাটি পুরাতত্ত্ব গবেষকদের জন্য খুবই মূল্যবান একটি নিদর্শন। এক সময় গুহাটির ভেতরে পানি ছিল। কালের বিবর্তনে এখন আর পানির অস্তিত্ব নেই। গুহাটি এখন শুকনো।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ১৫

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ