নভেম্বর ১২, ২০১৮ ১৮:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: সুলতান ফতেহ আলির নির্মিত সাইয়্যেদ মসজিদ

সাইয়্যেদ মসজিদ। বেশ প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক একটি মসজিদ।

যানজন প্রদেশের রাজধানী যানজন শহরের ঐতিহাসিক দিক থেকে মূল্যবান নিদর্শনগুলোর একটি হলো এই সাইয়্যেদ মসজিদ। এই মসজিদটি আসলে একটি মাদ্রাসাও বটে। তবে মসজিদের নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছে স্থাপনাটি। এমনিতে প্রাচীন স্থাপনা।১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে ফতেহ আলি শাহ কাজারের সন্তানদের মধ্য থেকে কোনো একজনের শাসনামলে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণ করেছিলেন যিনি এই মসজিদটি তাঁর জীবিতাবস্থায় মসজিদটি বহু নামে পরিচিত ছিল। যেমন মসজিদে দারা, মসজিদে সাইয়্যেদ, মসজিদে সুলতানি এবং এমনকি মসজিদে জুমা নামেও ডাকা হত।

যানজনের দীনি মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে কিংবা মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে বড় স্থাপনা হিসেবে এই সাইয়্যেদ মসজিদ কমপ্লেক্সের অনন্য ঐতিহাসিকতা সর্বজনবিদিত।আঙিনার চারপাশে ঝুলন্ত বারান্দার সিস্টেমে করা হয়েছে এ মসজিদ। আঙিনাটি লম্বায় ৪৮ মিটার আর প্রস্থে ৩৬ মিটার। আয়তক্ষেত্র আকারের খোলা আঙিনাটি মসজিদের অন্যতম আকর্ষণ। আঙিনার চারকোণে ঝুলবারান্দার নীচে রয়েছে চারটি রুম। এসব রুমে দীনি মাদ্রাসার ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝুলবারান্দার ভেতর এবং বাইরের দেয়ালে চমৎকার সব কারুকাজ করা হয়েছে। পুরো বারান্দাতেই রয়েছে টাইলসের কারুকাজ। তার উপর এবং নীচে রয়েছে বিচিত্র ক্যালিগ্রাফি। বিচিত্র রঙের সাহায্যে কুফি এবং সোলস ফন্টে করা কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফিগুলো যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি হৃদয়গ্রাহী। 

ফিরোজা রঙের টাইলস দিয়ে সূরা আদ-দাহরের ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। সোলস লিপিতে পবিত্র এই সূরার ক্যালিগ্রাফি মসজিদের গম্বুজটাকে সৌন্দর্যের পাশাপাশি দিয়েছে অন্যরকম মর্যাদা। এই মসজিদে তৈরি হয়েছেন অনেক বড় বড় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যাঁদের প্রভাবশালী চারিত্রিক মাধুর্যে প্রভাবিত হয়েছেন মানুষজন। 

সাইয়্যেদ মসজিদের মতোই আরেকটি নামকরা এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো সুলতানিয়া এবং তার বিখ্যাত গম্বুজ। যানজন থেকে ৫২ কিলোমিটার পূর্বে বিস্তীর্ণ একটি প্রান্তর রয়েছে। ওই প্রান্তরে ঘাস লতাপাতা থাকার কারণে তাকে ‘চামান সুলতানিয়া’ও বলা হয়। ফার্সি ভাষায় চামান মানে হলো ঘাস। এই চারণভূমিটি বহু দেশ থেকে বা দূর দূরান্ত থেকে আসা লোকজনের পছন্দ ছিল। এমনকি হিজরি ষষ্ঠ শতকের শেষ এবং সপ্তম শতকের শুরুর দিকে চীন থেকে এবং প্রাচীন উজবেকিস্তান থেকে যারা ইরানে আসতো সেইসব অভিবাসীরাও চামান সুলতানিয়াকেই বেছে নিত বসবাসের সুবিধার জন্য। 

ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল প্রমাণ থেকে জানা যায় যে এই সুলতানিয়াটি ‘আরগুন খান মঙ্গলের’ হাতেই প্রথম নির্মিত হয়েছে। তবে সুলতান মুহাম্মদ বা ‘আলজাইতু’র সময় আরো উন্নয়ন ঘটেছিল এই চামান সুলতানিয়ার। সুলতানিয়ার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলামী আরেকটি বিশাল স্থাপনা দেখা যায়। মণিমুক্ত মুক্তার ঔজ্জ্বল্য যেমন অনেক দূর থেকেও বুঝতে পারা যায় এই স্থাপনাটিও ঠিক তেমনি আপন ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রেখেছে যুগ যুগান্তর ধরে। স্থাপনাটির নাম হলো ‘সুলতানিয়া গম্বুজ’। এটা আসলে আলজাইতুর কবর। ইলখানিয়ানদের রাজধানী সুলতানিয়া শহরে ১৩০২ থেকে ১৩১২ খ্রিষ্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই স্থাপনা এখন ইসলামি এবং ইরানি স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। 

সুলতানিয়া গম্বুজটি আকারে বেশ বড়ই। গম্বুজের উচ্চতা ৬৬ মিটার আর ব্যস হলো ২৭ মিটার। আট কোণাকৃতি একটি ভিত্তির ওপর গম্বুজটি স্থাপন করা হয়েছে। বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী সাইয়্যেদ আলি শাহ এই স্থাপনার মূল শিল্পী। সুলতানিয়া গম্বুজের মূল তিনটি অংশ-প্রবেশদ্বার, মাযার বা সমাধিকক্ষ এবং কফিন রাখার জন্য মাটির নীচের রুম। পুরো সমাধি স্থাপনার ভেতরে যাতে আলোবাতাস আসতে পারে সেজন্য জানালার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ঝুলবারান্দার উপরে। তবে ওই জানালাগুলোকে সময় নির্ধারণের জন্যও ব্যবহার করা হত বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। গম্বুজকে ছোটো ছোটো সিরামিক বা টাইলস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ফলে এর সৌন্দর্য সহজেই অনুমেয়।

এই গম্বুজের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো দুই স্তর বিশিষ্ট ঢালাইয়ের কাজ। ইতালির বিশিষ্ট গবেষক সেন পাওলেযি এই গম্বুজ সম্পর্কে বলেছেন: ‘সারা বিশ্বে সম্ভবত সুলতানিয়া গম্বুজ স্থাপনার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আর কোনো স্থাপনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদিক থেকে এই স্থাপনাটির গুরুত্ব অপরিসীম’। এ ধরনের মন্তব্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে করা যেতে পারে সুলতানিয়া গম্বুজের ভেতর বাইরে কতো চমৎকার কারুকাজ করা হয়েছে। এ কারণেই স্থাপনাটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হবার পাশাপাশি ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক নিদর্শনেরও তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরই সুবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভ্রমণকারীরা, পর্যটকেরা ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি পরিদর্শনে আসেন। আর যারাই এখানে বেড়াতে আসেন তারাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে চমৎকার এবং অভিনব বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেন।

তৈমুরি শাসনামলের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হাফেজ আবরু এ সম্পর্কে লিখেছেন: ‘এটি একটি বিরল স্থাপনা, বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের স্থাপনার অস্তিত্ব মেলে না’।

প্রফেসর সেন পাওলেযি ইউরোপিয় গীর্যার গম্বুজের ওপর ইরানের সুলতানিয়া গম্বুজের প্রভাবের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী ইউরোপের সান্তা মারিয়া দেলফিউরে গির্জার ওপর যে গম্বুজটি স্থাপিত হয়েছে সেটি হয়েছে ১৪১৯ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ ইরানের সুলতানিয়া গম্বুজের অনেক পরে। আর এই গম্বুজ ছাড়া দুই স্তর বিশিষ্ট গম্বুজের অন্য কোনো নিদর্শনের উদাহরণ নেই, এশিয়ায় তো বটেই এমনকি ইউরোপেও। সুতরাং ব্রাউনলেস্কি গির্জার গম্বুজের ওপর ইরানের সুলতানিয়া গম্বুজের প্রভাব অনস্বীকার্য।

একইভাবে ফ্লোরেন্স শহরে যে বিশাল গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছে সেটিও ইরানের এই সুলতানিয়া গম্বুজের নির্মাণশৈলীকে কাজে লাগিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে। এই গম্বুজটি সান্তামারিয়া দেলফিউরে গির্জার গম্বুজ এবং আয়াসুফিয়া গম্বুজের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গম্বুজ। যাই সুলতানিয়া গম্বুজ শত শত বছর ধরে দর্শনার্থীদের দৃষ্টিকে নন্দিত করেছে। সাফাভি এবং কাজারি শাসনামলে গম্বুজটির ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এর মেরামতের কাজ চলছে। পুরাতাত্ত্বিক গবেষকগণ এই গম্বুজের আশেপাশে বহুবার খননকাজ চালিয়ে বহু প্রাচীন নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন যেগুলো বিভিন্ন সময়ের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ১২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ