মহানবীর (সা) নাতনী হযরত জয়নাব-সা. ও প্রতিরোধের বাণী ব্যাখ্যায় তাঁর ভূমিকা
https://parstoday.ir/bn/news/religion-i151224-মহানবীর_(সা)_নাতনী_হযরত_জয়নাব_সা._ও_প্রতিরোধের_বাণী_ব্যাখ্যায়_তাঁর_ভূমিকা
পার্সটুডে-হযরত জয়নাব (সা) ছিলেন ইসলামের মহানবী মুহাম্মাদ (সা) র প্রিয় নাতনী এবং ধৈর্য, প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের আদর্শ হিসেবে খ্যাতিমান।
(last modified 2025-08-18T12:31:55+00:00 )
আগস্ট ১৭, ২০২৫ ১৫:৪৮ Asia/Dhaka
  • মহানবীর (সা) নাতনী হযরত জয়নাব-সা. ও প্রতিরোধের বাণী ব্যাখ্যায় তাঁর ভূমিকা
    মহানবীর (সা) নাতনী হযরত জয়নাব-সা. ও প্রতিরোধের বাণী ব্যাখ্যায় তাঁর ভূমিকা

পার্সটুডে-হযরত জয়নাব (সা) ছিলেন ইসলামের মহানবী মুহাম্মাদ (সা) র প্রিয় নাতনী এবং ধৈর্য, প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের আদর্শ হিসেবে খ্যাতিমান।

হযরত ফাতেমা সা. (ইসলামের মহানবীর কন্যা) এবং ইমাম আলী- আ.'র (ইসলামের নবীর উত্তরসূরী ও স্থলাভিষিক্ত) কন্যা হযরত জয়নাব সা. ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁর অবিচল ব্যক্তিত্ব ও বহু ত্যাগের কারণে, তিনি আশুরার বিপ্লবের পতাকাবাহী এবং কারবালার বন্দীদের রক্ষক হিসেবে পরিচিত। এখানে আমরা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরছি:

জন্ম

হযরত জয়নাব হলেন ইমাম আলী ও হযরত ফাতিমার প্রথম কন্যা এবং ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের বোন। হযরত জয়নাবের জন্ম তারিখ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে: কিছু সূত্রে হিজরি ক্যালেন্ডারের ৫ম বছরের জামাদি আল-আউয়ালের ৫ তারিখে তাঁর জন্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আবার কিছু সূত্রে হিজরি ক্যালেন্ডারের ৬ষ্ঠ বছরে মদিনায় তাঁর জন্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

নামকরণ

হযরত জয়নবের নামকরণ ইসলামের নবী (সা.) করেছিলেন। বলা হয় যে, জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী (সা.)-এর কাছে এই নামটি পৌঁছে দিয়েছিলেন। "আল-খাসাঈস আজ-জায়নাবিয়্যাহ" বইতে বর্ণিত আছে: নবী (সাঃ) তাঁকে শৈশবে চুম্বন করেছিলেন এবং বলেছিলেন: "আমার উম্মাতের মধ্যে যারা উপস্থিত আছেন তারা যেন অনুপস্থিতদের আমার এই কন্যা জয়নাবের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেন; প্রকৃতপক্ষে, তিনি তার নানি হযরত খাদিজার মতো।" জয়নাবের আক্ষরিক অর্থ "একটি সুদৃশ্য ও সুগন্ধি গাছ" এবং "পিতার অলংকরণ"।

উপাধি

তার নামে অনেক উপাধি দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ তার জন্য ষাটেরও বেশি উপাধি উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে: বনু হাশিমের আকিলা তথা জ্ঞানী, আরিফা তথা আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞানী , মুওয়াস্‌সিকা বা নির্ভরযোগ্য, ফাদিলা বা গুণবতী এবং কামিলা তথা পূর্ণাঙ্গ মহামানব ইত্যাদি। হযরত জয়নাব (সা.) জীবনে নানাবিধ কষ্টের সম্মুখীন হওয়ার কারণে তাঁকে "দুঃখের জননী" বলা হয়;  তিনি তাঁর নানা ইসলামের মহানবীর মৃত্যু, তাঁর মা ফাতিমার অসুস্থতা ও শাহাদাত, তাঁর পিতা আমিরুল মুমিনদের শাহাদাত, তাঁর ভাই ইমাম হাসানের ও ইমাম হুসাইনের শাহাদাত, কারবালার ঘটনা এবং কুফা ও সিরিয়ায় তাঁর বন্দীদশা- ইত্যাদি তাঁর জীবনের নজিরবিহীন কঠিন ও তিক্ত ঘটনাগুলোর অন্যতম।

বিবাহ

ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে বিপুল সংখ্যক পাত্রের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও, হযরত জয়নাব তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাফরকে বিয়ে করেছিলেন যার মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল তার চার ছেলে ও এক মেয়ের।

কারবালার ঘটনায় ইমাম হুসাইনের সঙ্গী ও এ বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর আলোকপাত 

অনেক ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনাকে হযরত জয়নবের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করেন। তিনি ইমাম হুসাইনের শাহাদাত পর্যন্ত কারবালার ঘটনায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন। ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পর, তাদেরকে অন্যান্য জীবিতদের সাথে বন্দী করে কুফা ও সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের শত্রুদের মোকাবেলা ও মুখোশ উন্মোচন এবং তাদের ভাই ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পর আহলে বাইতের মর্যাদা ও তাদের ওপর করা অবিচারের বর্ণনা তুলে ধরার জন্য হযরত জয়নবকে কারবালা বিপ্লবের পতাকাবাহী বলে সম্মান জানানো হয়।

তাঁর নানা ভাষণ এবং সত্যকে তুলে ধরার আয়োজন আশুরার বীরত্বপূর্ণ ঘটনাকে মানুষের স্মৃতিতে টিকিয়ে রাখার এবং মানুষকে প্রতিরোধকামী হিসেবে জাগিয়ে তোলার রহস্য হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ইরানের একজন ধর্মীয় লেখক মোহাম্মদ মোহাম্মদী এশতেহারদী আশুরার পর হযরত জয়নবের তিনটি লক্ষ্য বা মিশনের কথা বর্ণনা করেছেন: বন্দীদের তত্ত্বাবধান করা, ইমাম হুসাইনের পুত্র ইমাম সাজ্জাদকে মদদ ও পাহারা দেওয়া এবং শহীদদের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।

সিরিয়ায় ইয়াজিদের আয়োজিত সমাবেশে তাঁর ভাষণ 

কারবালার বন্দিদের কাফেলা যখন ইয়াজিদের প্রাসাদে প্রবেশ করে, তখন প্রাসাদে সিরিয়ার প্রবীণ ও ধর্মীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি আনুষ্ঠানিক সমাবেশ করা হয়। এ সময় ইয়াজিদের নির্দেশে বন্দিদেরকে সমাবেশে আনা হলে যখন সবার দৃষ্টি তাঁদের ওপর নিবদ্ধ ছিল তখন হযরত জয়নাব সা. ইয়াজিদকে সম্বোধন করে বললেন:

হে তুলাকাদের সন্তান! (মক্কা বিজয়ের পর পরাজিত আবু সুফিয়ানসহ বনী উমাইয়া গোত্রের লোকদেরকে মহানবী (সা.) কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত দাস তথা তুলাকা বলে অভিহিত হত) নিজের স্ত্রী, দাসী ও নারীদেরকে পর্দাবৃত করে রেখেছিস আর মহানবীর (সা.) কন্যাদেরকে মুখমণ্ডল খোলাবস্থায় এবং অনাবৃত করে শত্রুদের সাথে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরাচ্ছিস অথচ তাঁদেরকে এ ঘোর দুর্দিনে সহায়তা করতে পারে এমন লোকেরা কেউ বেঁচে নেই- এটা কি ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার নমুনা?... খোদার কসম করে বলছি, তুই আমাদের নাম কখনো মুছে ফেলতে পারবি না। আমাদের রসূলের ওহীকে স্তব্ধ ও ধ্বংস করতে পারবি না এবং তোর নিজের পাপ থেকেও রেহাই পাবি না। কারণ তোর বিবেক বুদ্ধি বিকারগ্রস্থ। তোর আয়ুষ্কালও সীমিত। তোর সংগী-সাথীরা অবশ্যই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। যেদিন আহ্বানকারী বলতে থাকবে, “খোদার অভিশাপ অত্যাচারীদের উপর বর্ষিত হোক।” ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি আমাদের ভাগ্যকে সৌভাগ্য ও ক্ষমার দ্বারা আরম্ভ করেছেন এবং তা শাহাদাত ও রহমত প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করেছেন।

হযরত জয়নাবের সাহসি কণ্ঠে অপরাধীদের স্বরূপ-উন্মোচনকারী ভাষণ ও বক্তব্য দানের ফলে ইবনে যিয়াদ, ইয়াজিদ এবং উমাইয়াদের বিজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। বলা হয় যে হযরত জয়নাবের আলোকিতকরণের ফলে ইয়াজিদ ক্ষমা চাইতে ও অনুশোচনা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের জন্য উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে দায়ী করে।এরপর হযরত জয়নাব-সা. ও কারবালার বন্দীরা সিরিয়ায় ইমাম হুসাইনের জন্য শোক পালনের অনুমতি দিতে ইয়াজিদকে অনুরোধ করেন এবং ইয়াজিদ রাজি হয়।

ধৈর্য ও প্রতিরোধ

হযরত জয়নবকে ধৈর্যের প্রতীক এবং প্রতিরোধের বীরাঙ্গনা বলা হয়। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার পথে প্রতিরোধ, প্রতিকূলতার মুখে আত্মনিয়ন্ত্রণ, শত্রুর মুখোমুখি হয়েও দুর্বলতা না দেখানো এবং মানুষের উপস্থিতিতে দুর্ভোগ বা দুর্দশা সম্পর্কে অভিযোগ না করা হযরত জয়নাবের ধৈর্যের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম।
আশুরার দিন যখন তিনি তার ভাই ইমাম হুসাইনের রক্তাক্ত দেহ দেখেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: "হে আল্লাহ, আমাদের (নবীর পরিবারের) কাছ থেকে আপনার পথে এই ত্যাগ এবং শাহাদাত কবুল করুন।" তিনি ইবনে জিয়াদের একটি প্রশ্নের উত্তরেও যা বলেছিলেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ইবনে জিয়াদ টিটকারি করে হযরত জয়নাবকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিনি কারবালায় তাঁর ভাই এবং তাঁর পরিবার পরিজন তথা আহলে বাইতের সাথে আল্লাহর আচরণকে কীভাবে দেখেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন: "আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখিনি।"

হযরত জয়নাবের বীরত্ব

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী, প্রতিরোধের বাণী দক্ষতার সঙ্গে প্রচারে সফল এই মহিয়সী নারী হযরত জয়নাবের উচ্চতর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে বলেছেন:জয়নাব আল-কুবরা (সা.)-এর বীরত্ব আশুরার বীরত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর পরিপূরক। জয়নাব আল-কুবরা (সা.)-এর কাজের মাহাত্ম্যকে ইতিহাসের অন্যান্য মহান ঘটনার সাথে তুলনা করে পরিমাপ করা যাবে না; এটি আশুরার ঘটনার সাথে তুলনা করে পরিমাপ করা উচিত; এই মহান মানবী, ইসলাম ও মানবতার এই মহান নারী নানা বিপদ ও কষ্টের ভারী পাহাড়ের মুখেও নিজের মর্যাদা দৃঢ় ও উন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন... শত্রুদের মুখোমুখি হয়ে,  নানা দুর্যোগ ও তিক্ত ঘটনার মুখোমুখি হয়েও তিনি গর্বিত পর্বত শিখরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন; তিনি হয়ে ওঠেন অনুকরণীয় শিক্ষা, একজন আদর্শ, একজন নেতা ও একজন পথিকৃৎ।

মৃত্যু ও সমাধিস্থল

হযরত জয়নব ৬২ হিজরী সনের ১৫ই রজব তারিখে ইন্তেকাল করেন এবং সিরিয়ার দামেস্কে তাঁকে দাফন করা হয়। #

পার্স টুডে/এমএএইচ/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।