অক্টোবর ৩১, ২০১৮ ০২:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: ইরানের ঐতিহাসিক ‘যানজন’ প্রদেশ

ইরান একটা বিচিত্র সংস্কৃতি আর আচার প্রথার দেশ।

একই দেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এতো বেশি যে বলাই বাহুল্য। 

যানজন একটা ঐতিহাসিক প্রদেশ। ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রাচীন বহু নিদর্শন যেমন রয়েছে এখানে তেমনি রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনবহুল এই প্রদেশটি তাই ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করে এসেছে যুগে যুগে। ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এই প্রদেশটির আয়তন ২২ হাজার এক শ’ ৬৪ বর্গকিলোমিটার। যানজন প্রদেশের উত্তরে রয়েছে গিলান এবং আর্দেবিল প্রদেশ। উত্তর-পূর্ব এবং পূর্বদিকে রয়েছে ক্বাযভিন প্রদেশ, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পড়েছে কুর্দিস্তান প্রদেশ, পশ্চিম দিকে পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশ আর উত্তর পশ্চিম দিকে রয়েছে পূর্ব আজার বাইজান প্রদেশ।

 যানজন প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহরের নাম যানজন। এছাড়াও এই প্রদেশের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শহর হলো আবহার, ইজরুদ, খোররাম দাররে, খোদাবান্দে, তরোম ও মা’হ ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে যে এই প্রদেশের শতকরা প্রায় নব্বুই ভাগ মানুষই তুর্কি ভাষী। আর বাকি দশ ভাগের একটা অংশ ফার্সি ভাষায় কথা বলে। আরো কয়েক ভাষার লোকজনেরও বসবাস রয়েছে এই প্রদেশে। আলবোর্য এবং যাগরোস পর্বতমালা যেখানে এসে পরস্পরে মিলেছে ঠিক সেই অবস্থানে পড়েছে যানজন প্রদেশ। বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রদেশটি পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত। অনেক উঁচু উঁচু পর্বতচূড়া দেখতে পাওয়া যাবে এই প্রদেশে।

যানজন প্রদেশ সামগ্রিকভাবে দুই অঞ্চলে বিভক্ত। এই বিভাজনটি প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। একটি হলো পার্বত্য এলাকা, অপরটি উর্বর সমতলভূমি। প্রদেশের অসমতল এলাকাও দুই ভগে বিভক্ত। একটি উত্তরাঞ্চলীয় যানজন পার্বত্য এলাকা অপরটি দক্ষিণ যানজন পার্বত্য এলাকা। উত্তরাঞ্চলীয় যানজনের পাহাড়গুলো মূলত আলবোর্য পর্বতমালারই অংশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গেলা’স পর্বতচূড়া, বাকলুর পর্বতচূড়া, দাগা পর্বতচূড়া, চেলেখানা চূড়া ইত্যাদি। এই পর্বতগুলো যানজনের উত্তরপশ্চিমে একটির সাথে আরেকটি গায়ে গায়ে লেগে আলবোর্যের পশ্চিমাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। আর দক্ষিণাঞ্চলীয় যানজনের পাহাড়গুলো কেন্দ্রীয় পর্বতমালার অংশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কেইদার চূড়া, খোরজাহন চূড়া, আলামকান্দি চূড়া, সেপাহসালার চূড়া এবং রোস্তম চূড়ার মতো উঁচু উঁচু পর্বতচূড়া। এখানে বেশ কয়েকটি নদীও আছে। গেযেল উযান নদী, যানজন নদী, আবহার নদী এবং কাবির নদী।

পার্বত্য এলাকা হবার কারণে যানজনের আবহাওয়া দুই ধরনের। পার্বত্য এলাকার আবহাওয়া তো সাধারণত একটু ঠাণ্ডা আর পার্বত্য এলাকার বাইরে রয়েছে গরম এবং কিছুটা আর্দ্র আবহাওয়া। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যানজন প্রদেশের আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে নাতিশীতোষ্ণ আর শীতকালে ব্যাপক ঠাণ্ডা এবং তুষারময়। তবে যানজনে সারা বছর ধরেই অর্থাৎ বিভিন্ন ঋতুতে বায়ু প্রবাহ থাকে। একদিকে উর্বর মাটি অপরদিকে আবহাওয়াগত বৈচিত্র্য আর পানির অভাব না থাকা ইত্যাদি কারণে যানজন কৃষিকাজ করার জন্য একটি উপযোগী এলাকা। চাষ তো দুই রকমের হয় সাধারণত। একটা চাষ হয় পানি সিঞ্চনের মাধ্যমে আবার পানি সেচন না করে শুধু বৃষ্টির পানির সাহায্যেও চাষাবাদ করার রেওয়াজ আছে। এই দুই রকমেরই চাষাবাদ হয় যানজন এলাকায়। তবে পানি সরবরাহ করে সমতল কৃষিজমিতেই চাষাবাদ হয় বেশি। আর বৃষ্টির পানির সাহায্যে চাষ হয় পার্বত্য এলাকায় বিশেষ করে পর্বতের পাদদেশে।

 ইরানের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু এবং উন্নতমানের আঙুর হয় যানজন প্রদেশে। খুবই বিখ্যাত এখানকার আঙুর। এই প্রদেশের ফলপাকড় এবং কৃষিপণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হয়। যানজনের রপ্তানীযোগ্য ফল আর কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে ডুমুর, চাউল, আঙুর, খুবানি বা এপ্রিকট, আপেল, বরবটি, শসা, পেঁয়াজ, আখরোট, এক ধরনের গোল বাদাম যাকে ইংরেজিতে হ্যাজেল-নাট বলা হয়, বাদাম, যেইতুন, আনার এবং রসুন। এসব ফলফলাদি আর কৃষিপণ্যের বেশিরভাগই উৎপন্ন হয় তরোম এলাকায়।

যানজন প্রদেশটি আসলে ইরানের মধ্যে বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানের মধ্যে কৃষিকাজ আর পশুপালনের জন্যে খুবই বিখ্যাত। এই দুটি পেশা যানজনের শিল্পের সাথে এবং ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে গেঁথে গেছে। তার মানে প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষানুক্রমে এই দুটি পেশা চলে আসছে। পশুপালনের রেওয়াজটি এখানকার উপজাতীয়দের মাঝে বেশি প্রচলিত। এরা মেষ জাতীয় পশু বেশি পালে। মেষ বা দুম্বার পাশাপাশি মুরগি পালনেরও রেওয়াজ এখানে ব্যাপক।

শিল্প এবং খনিজ দিক থেকেও যানজনের অবস্থান অনুল্লেখ্য নয়। গিলান এবং তেহরানের কাছে অবস্থিত হবার কারণে যানজন প্রদেশটি শিল্প-কলকারখানার দিক থেকে দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে। সরকারও সেখানে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে এবং শিল্পখাতে বাইরে থেকেও বিনিয়োগ আসছে। এসব কারণে সম্প্রতি যানজন প্রদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।                

খনিজ সম্পদের দিক থেকেও যানজন প্রদেশ খুবই সমৃদ্ধ। বহু রকমের খনিজ পদার্থ এখানে রয়েছে। বিশেষ করে ইস্পাত এবং জিংকের জন্য সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে যানজন অনন্য। খনিজ সম্পদের বাইরে যানজনে রয়েছে হস্তশিল্প সামগ্রীর পসরা। বিচিত্র হস্তশিল্প তৈরি হয় যানজনে। যেসবের রেওয়াজ একটু বেশি সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: গেলিম বোনা, সূতি কাপড়ের জুতা-এগুলো রেশমি কাপড় দিয়ে যেমন তৈরি হয় তেমনি সূতার কাপড় দিয়েও তৈরি হয়, মাটি দিয়ে তৈরি বিচিত্র জিনিস, তৈজসপত্র, ঘরে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী, বিচিত্র চাকু ছুরি, জাজিম ইত্যাদি।

 এই তো গেল শিল্পসামগ্রী আর খনিজ সম্পদের কথা। যানজন প্রদেশটি কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে অসাধারণ। প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহরটিও যানজন নামেই প্রসিদ্ধ। এখানকার আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চোখ কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর। গরমের সময় চমৎকার এই শহরটি যেন শিল্পীদের শহরে পরিণত হয়। প্রকৃতিপ্রেমিরা এ সময় যানজনে বেড়াতে আসেন ব্যাপকহারে। শহরটি শাসানী শাসনামলে আর্দেশির বাবকানের হাতে গড়ে উঠেছে বলে ইতিহাসে এসেছে। তবে তৈমুরলঙ মঙ্গলের হামলায় শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কাজার শাসনামলে অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকে পুনরায় গড়ে ওঠে। সেইসব ইতিহাসের বহু নিদর্শন এখনো সেখানে দেখতে পাওয়া যাবে। যানজন বাজার কমপ্লেক্স এখনো এখানকার দেখার মতো একটি স্থাপনা। আজ আর নয়।#

 

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ৩১

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ