আগস্ট ১০, ২০১৮ ১৭:৩১ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭৬ : পশ্চিমা সভ্যতার মডার্নিটি বা আধুনিকতা

আঠারো শতকের শেষের দিকে এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিমা সভ্যতায় চিন্তাদর্শগত অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বস্তুত ক্ল্যাসিক পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং পশ্চিমা সভ্যতা মডার্নিটি বা আধুনিকতা নামে নতুন পর্বে উন্নীত হয়।

মডার্নিটির উদ্ভবের সাথে সাথে প্রাচীন যুগের অবসান হয়। ফরাশি সমাজ বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ জ্যঁ ব্রদিয়া মনে করতেনঃ আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যই হলো ঐতিহ্যের বিরোধিতা অর্থাৎ সর্বপ্রকার প্রাচীন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আধুনিকতার অবস্থান। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমা সমাজে মানুষের সকল দুঃখ কষ্ট আর সর্বপ্রকার সমস্যা দেখা দিয়েছে সেই সময় থেকে যখন মানুষ হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম, সেকুলারিজম কিংবা অন্যভাবে বলা যায় মুনাফালোভ, ভোগ লিপ্সা, ব্যক্তিচিন্তা, বস্তুচিন্তার পেছনে নিজেকে নিমজ্জিত রেখে আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে গেছে।

পশ্চিমা সভ্যতায় যারা বেড়ে উঠেছে, তারা মানবীয় পবিত্রতা থেকে দূরে সরে গিয়ে মানব সমাজকেই ধ্বংসের পথে ধাবিত করেছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ যত যুদ্ধ বেধেছে, গোত্রীয় এবং বর্ণগত যত দ্বন্দ্ব সংঘাত বাধানো হয়েছে সবই ঘটিয়েছে তারা। পাশ্চাত্যের বহু চিন্তাবিদ ও সমালোচক মডার্নিটি এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। তাদের বিশ্বাস হলো পশ্চিমা চিন্তাদর্শ শিল্প, পুঁজিবাদ ও মডার্নিটির যুগে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে মূলত ধ্বংস এবং পতনের দ্বারে গিয়ে পৌঁছেছে। পশ্চিমা জগতে সভ্যতা গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। নতুন এই সভ্যতার নেতিবাচক দিকগুলো যখন বিনা বাধায় কোনোরকম ভূমিকা ব্যতিরেকেই খুব দ্রুততার সাথে প্রাচ্যভূবনে প্রবেশ করে, তখন প্রাচ্যের জাতীয় এবং ধর্মীয় জগতে বিশেষ করে মুসলমানদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধগুলোর সাথে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য দেখা দিয়েছিল।

পাশ্চাত্য তাই নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা চেষ্টা করেছে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং আদর্শগুলোকে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার নামে প্রাচ্যের ওপর চাপিয়ে দিতে। রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করার চিন্তাধারা বিস্তৃতি পাবার ফলে এবং সতেরো ও আঠারো শতকে ঔপনিবেশিক চেতনার কথাবার্তা উঠলে প্রাচ্যবাসীদের মনে পশ্চিমাদের দ্বৈত বা বৈষম্যমূলক চিন্তার একটা চিত্র ফুটে ওঠে। প্রাচ্যবাসীরা বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের মুসলমানরা পশ্চিমাদের সেই উপনিবেশবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেয়।

কারণটা হলো পশ্চিমারা আসলে প্রাচ্যে এসেছিল তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলোকে চাপিয়ে দিতে। এ কারণে স্থানীয় চিন্তাবিদদের মাঝে বিশেষ করে বিশ শতকের দূরদর্শী চিন্তাবিদদের মাঝে সংস্কারকামী এবং জাগরণমূলক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটতে থাকে। পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করতেই এই চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চিন্তাবিদদের এই রুখে দাঁড়ানোর ফলে যে উপকারটি হলো তাহলো মুসলমানরা আরো একবার জাতীয় এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোর জাগরণের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পশ্চিমা সভ্যতার সমালোচনায় ইরানও ছিল ব্যাপক সোচ্চার। ইরানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিভিন্ন যুগে বিশেষ করে পাহলভি রাজবংশের শাসকদের বিরোধী চিন্তাবিদরা পশ্চিমা সভ্যতার সমালোচনা করেছেন। বহু চিন্তাবিদ এক্ষেত্রে বেশ অগ্রসর ছিলেন। এক্ষেত্রে সবার আগে যে নামটি উঠে আসবে তিনি হলেন জালাল আল আহমাদ। ১৯৬২ সালে ‘পাশ্চাত্যের প্রভাব’ নামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি বইও লিখেছিলেন। সমালোচনামূলক এ বইটিতে পশ্চিমাদের মোকাবেলায় প্রাচ্য পরিস্থিতিকে তুলে ধরা হয়েছে। সেইসাথে পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী স্বরূপকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পশ্চিমা সভ্যতাকে মোকাবেলা করার জন্যে জালাল আল আহমাদ আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক শক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন সামাজিক সংগ্রামে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ ও চিন্তাবিদদের পারস্পরিক সহযোগিতা থাকলে মুসলমানদের শক্তি বেশ মজবুত হবে। আর সেই সহযোগিতা শক্তি কাজে লাগাতে পারলে ইতিবাচক ফল বয়ে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

ইসলামকে সর্বপ্রথম যে ধর্মীয় আলেম একটি রাজনৈতিক আদর্শের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন, তিনি হলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনি (রহ)। ইমাম ইসলামী সভ্যতা, ঐতিহ্য এবং আদর্শকে খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। বিভিন্ন শ্রেণীর জনতাকেও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্যে তিনি সকল আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সংগঠিত হবার জন্যে। প্রকৃতপক্ষে নতুন করে ইসলামের চিন্তাদর্শ যে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো তা ইমাম খোমেনী (রহ) এর বিপ্লবী চিন্তাধারার ছায়াতলেই বেড়ে উঠেছে। এরিমাঝে ডক্টর আলি শারিয়াতির মতো চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করতে হয়। তিনি পশ্চিমাদের উপনিবেশবাদী চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাধারার নাম ছিল ‘মূলে ফেরা’।

উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে আরব তাত্ত্বিকগণ -যারা মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ ভূখণ্ড জুড়ে নেতৃত্বে ছিলেন -তারাও পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। এই আরব বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে পশ্চিমারা প্রকৃতিগতভাবেই লুটেরা এবং অপরাপর কওম বা জাতির মোকাবেলায় নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে ভাবতে অভ্যস্ত। আরব চিন্তাবিদ ‘আব্দুর রাহমান কাওয়াকেবি’র কথা উদাহরণত উল্লেখ করা যায়। তিনিও পশ্চিমা ইম্পেরিয়ালিজমের ব্যাপারে অভিন্ন চিন্তার প্রবক্তা ছিলেন। আরব চিন্তাবিদদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো পশ্চিমাদের মিথ্যা সভ্যতার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া। তবে সর্বপ্রথম যে আরব চিন্তাবিদ পশ্চিমা রাজনীতি এবং সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ইসলামী জাগরণের কথা বলেছিলেন তিনি হলেন শেখ মুহাম্মাদ আবদুহ।

আরেকজন আরব কবি এবং চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করতে হয়। তিনি হলেন সমকালীন নামকরা কবি আহমাদ আলি সায়িদ। তিনি পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে বলেছিলেনঃ “ইউরোপকে আর বিশ্বাস করি না, তাদের দর্শন কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আর বিশ্বাস নেই। সামাজিক কাঠামো এবং....তাদের আত্মা খেয়ে গেছে পোকায়”....

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামী জাগরণমূলক আন্দোলন নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়। বলা বাহুল্য, এই বিপ্লবের ফলেই ইসলামী জাগরণের সুবাতাস বয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী যেমনটি বলেছিলেনঃ একবিংশ শতাব্দি হবে ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতার শতাব্দি। এই যুগ ইসলাম এবং মুসলমানদের বিজয়, উন্নয়ন এবং জাগরণের যুগ।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১০