আগস্ট ২৮, ২০১৮ ২০:২৭ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭৮ : ইসলামে মানবাধিকার

‘সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে আল্লাহর নবীদের আবির্ভাবের সূচনা থেকেই মানবাধিকার বিষয়টি বিশেষ করে দ্বীনে ইসলামে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতিহাস পরিক্রমায় সকল ঐশী ধর্মই মানবাধিকারের মৌলিক নীতিমালার প্রতি ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহর নবীরাসূলগণ মানুষকে বিচিত্র বন্দীত্ব আর দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্যে এবং মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সেইসাথে সমাজে বিদ্যমান জুলুম নির্যাতন আর তাগুতদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ছিলেন সুদৃঢ় এবং একপায়ে দাঁড়ানো।’

ইতোমধ্যে আমরা বিংশ শতাব্দি অতিক্রম করেছি এবং নতুন একটি সহস্রাব্দে পা রেখেছি। নতুন এই সহস্রাব্দেও আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ ও সরকারগুলো ডেমোক্রেসি ও মানবাধিকারের নামে অপরাপর দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেই চলছে। এই সরকারগুলো অন্যান্য দেশকে তাদের সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমা মূল্যবোধসহ সকল আদর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য করতে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। কিন্তু পশ্চিমা ধাঁচের মানবাধিকার কি প্রাচ্যের সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি বা সামগ্রিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ? মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতির আজকের পর্বে আমরা পাশ্চাত্যে মানবাধিকারের ঐতিহ্য এবং একইভাবে মানুষের মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করবো।

হিউম্যান রাইট্স বা মানবাধিকার আসলে নৈতিক অধিকারেরই একটা বিশেষ শ্রেণী যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদে সকল মানুষেরই সমান অধিকারের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেইসাথে কে কোন্ সমাজের বা কোন‌্ ধরনের দল ও গোষ্ঠির সদস্য সে বিষয়টির ওপর দৃষ্টি না দিয়েই অধিকারের ব্যাপারটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়। মানবাধিকার একটি সার্বজনীন নৈতিক বিধান এবং সবারই উচিত এই বিধানকে কাজে লাগানো। আধুনিক এই বিশ্বে মানবাধিকার অভিধা বা পরিভাষাটির বয়স খুব বেশি নয়। বড়ো জোর বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত তার উদ্ভব ও বিস্তারের পরিসীমা, বিশেষ করে বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা পর্যন্ত তার শেকড় বিস্তৃত বলা যায়, তবে এই সংজ্ঞাটি কিন্তু বেশ পুরোণো। মানবাধিকারকে বিশেষ কোনো সভ্যতা কিংবা বিশেষ কোনো যুগের সাথে সম্পৃক্ত করা যাবে না। সকল মাযহাব, সকল মতাদর্শ এবং সাহিত্য ও দর্শনের মহান গ্রন্থগুলোতে তার উল্লেখ রয়েছে। বিশ শতকের মাঝে এবং বিশেষ করে বিশ শতকের শেষের দিকে মানবাধিকার বিষয়ক বহু আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয়েছে, এগুলো মানবাধিকারের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

মানবাধিকারের কাঠামোগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গঠিত হয়েছে। বিশ্ব সমাজ হিটলারের নির্মমতা আর অপরাধযজ্ঞের শিকার হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে একটা কাঠামো বা সংস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুদ্ধে জড়িত দেশ এবং সরকারগুলো চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধরত দেশগুলোর কর্মকর্তাগণ সিদ্ধান্ত নেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে একটা মেথড বা পদ্ধতি আবিষ্কার করবেন। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন জাতিসংঘের ঘোষণা তৈরি হয় এবং সদস্যদের স্বাক্ষর গৃহীত হয়। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সমাজ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে ‘বিশ্ব মানবাধিকার সনদ’ নামক গুরুত্বপূর্ণ এই ঘোষণাটি পাশ করতে সক্ষম হয়। এই মানবাধিকার ঘোষণাটির একটি ভূমিকা এবং ত্রিশটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা এবং অধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর এই ঘোষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আমরা যে মানবাধিকার সনদটির কথা বললাম এটি মানবাধিকার বিষয়ক অন্যান্য সনদের ফাউণ্ডেশান বা ভিত্তি প্রস্তরের মতোই গুরুত্ববহ। এগুলোকে এমনভাবে সংকলন করা হয়েছে যে, বেশিরভাগ চিন্তাবিদই এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নকে খুবই জরুরি বলে মনে করেন। এই ঘোষণার অন্তর্নিহিত অর্থ কাজে লাগানোর জন্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যাতে মানবাধিকার রক্ষা করে চলে সেজন্যে প্রয়োজনীয় চুক্তি বা স্মারকগুলোও পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে গৃহীত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই সনদগুলোর মধ্যে রয়েছে গণহত্যা নিষিদ্ধ করণ বিষয়ক কনভেনশন, বর্ণ-বৈষম্য নিষিদ্ধ সংক্রান্ত কনভেনশন, বর্ণবাদ বা বর্ণপূজা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত কনভেনশন, নির্যাতন-নিপীড়ন বিরোধী কনভেনশন, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য রোধ সংক্রান্ত কনভেনশন এবং শিশু অধিকার বিষয়ক কনভেনশন ইত্যাদি।

আগেই বলেছি যে আধুনিক বিশ্বে মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। অথচ সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার সেই আল্লাহর নবী-রাসূলদের আবির্ভাবের সূচনা থেকেই উপস্থাপিত হয়েছে, বিশেষ করে দ্বীনে ইসলামে মানবাধিকার একেবারে বিধিবদ্ধ হয়েছে। ইতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে ঐশী দ্বীন বা ধর্মগুলো মানবাধিকারের মূলনীতিগুলোর প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। হযরত নূহ (আ), ইব্রাহিম (আ), মূসা (আ), ঈসা (আ) এবং ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) মানুষকে বিচিত্র বন্দীত্ব আর দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্যে এবং মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সেইসাথে সমাজে বিদ্যমান জুলুম নির্যাতন আর তাগুতি শক্তির মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ছিলেন সুদৃঢ় এবং একপায়ে দাঁড়ানো। কুরআনে কারিম আর নবীজীর সুন্নাত নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, মানবাধিকারের  মূলনীতিগুলোর প্রতি ইসলামে পরিপূর্ণ ও সামগ্রিকভাবে এবং একেবারে বাস্তবতার আলোকেই যথার্থ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা পশ্চিমা বিশ্বদৃষ্টির আলোকে একেবারেই হাল আমলের ঘটনা। এই ঘোষণায় নৈতিকতা কিংবা ফযিলতের স্থান নেই। মানবাধিকারের এই আধুনিক চিন্তাদর্শ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ইসলামী মানবাধিকার চিন্তার সাথে বা এর শিক্ষাগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বরং বহু ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের স্থান অনেক উর্ধ্বে। এতো উর্ধ্বে যে ফেরেশতাদের সেজদা পাবার যোগ্য এবং আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর এই সৃষ্টি মূল্যহীন হতে পারে না। পবিত্র কুরআনেও বহুবার মানুষের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় যা কিছু বলা হয়েছে সেসব ঐশী দ্বীন বিশেষ করে দ্বীনে ইসলামের বৈশিষ্ট্যগুলোর ছিটেফোঁটামাত্র।

মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি হলো স্বাধীনতা ও মুক্তি। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় এ বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যথাযথভাবেই। আর ইসলাম এ বিষয়টির ওপর ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ স্বাধীন অবস্থায় জন্ম নিয়েছে, তাই তাদের অধিকার রয়েছে স্বাধীন জীবন যাপন করার। ইমাম আলী (আ) বলেছেনঃ “অন্য কারো গোলাম হয়ো না কেননা আল্লাহ পাক তোমাকে মুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন।” উল্লেখ্য যে, বিশ্বাস এবং বাক-স্বাধীনতার মতো বহুরকম স্বাধীনতার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ রয়েছে। দুঃখজনকভাবে পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতার বাস্তব অর্থ হলো নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে অবস্থানের স্বাধীনতা, লাগামহীনতা এমনকি অন্যদের অবমাননা করার স্বাধীনতা-যার পরিণতিতে পতন আর বিচ্যুতির কোনো বিকল্প নেই। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মৌলিক একটি অধিকার হলো ন্যায়ানুগ আচরণ।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৮

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন