আগস্ট ৩০, ২০১৮ ২০:২৬ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৭৯ : ইসলামী জাগরণ

নতুন এই সহস্রাব্দে আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ ও সরকারগুলো ডেমোক্রেসি এবং মানবাধিকারের নামে অপরাপর দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেই চলছে।

এই সরকারগুলো অন্যান্য দেশকে তাদের সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমা মূল্যবোধসহ সকল আদর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য করতে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। কিন্তু পশ্চিমা ধাঁচের মানবাধিকার যে প্রাচ্যের সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি বা সামগ্রিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় সে ব্যাপারে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে আমরা দেখবো মুসলিম বিশ্বের জেগে ওঠার চিত্র। মুসলমানরা উপলব্ধি করতে পেরেছে ইসলামের শিক্ষার প্রতি অবহেলা আর পাশ্চাত্যের আধিপত্যই তাদের পেছনে পড়ে থাকার কারণ। আমরা এ বিষয়ের ওপর আলাপ করতে গিয়ে ফিরে তাকাবো আরব, ইরান, তুরস্ক, ভারত উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকার বিগত দুই শ বছরের ইতিহাসের দিকে।

ইসলামী জাগরণের ধারার সূত্রপাত হয় নতুন সভ্যতার সাথে ইসলামকে সুসঙ্গত করে তোলার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। এটা হিজরি তেরো শতক তথা খ্রিষ্টিয় উনবিংশ শতাব্দির  শুরুর দিকের ঘটনা। সেই যে ইসলামী জাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল, আজ পর্যন্তও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে যদিও জাগরণের ধারা কমবেশি সমগ্র বিশ্বব্যাপীই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তবে এই জাগরণের উদ্ভব হয়েছিল মুসলিম বিশ্বের চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড বা দেশ। একটি হলো ইরান, আরেকটি হলো আরব বিশ্ব বিশেষ করে মিশর এবং সিরিয়া, আরেকটি হলো ওসমানীয় তুরস্ক এবং চতুর্থ ভূখণ্ডটি হলো ভারত। সমগ্র পৃথিবীতে আরব বিশ্ব হলো ইসলামী জাগরণের অন্যতম একটি কেন্দ্র। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, যুগে যুগে বিশেষ করে সংকটাপন্ন খরার কালে যখন রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা গড়ে ওঠার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল তখন আরবরা সেই সংকট নিরসনের উপায় খুঁজে বের করতে মৌলিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

আরবরা যখন বুঝতে পারলো ইউরোপীয় সরকারগুলো তাদের পশ্চাদপদতার কারণ, তখন তারা সমস্যা সমাধানের বহু পন্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। সেসব প্রচেষ্টারই একটি হলো পুনরায় ইসলাম ধর্ম, ইসলামের সমৃদ্ধ অবস্থান, ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আসলে আরব বিশ্বে ইসলামী জাগরণমূলক আন্দোলন এতোটাই বিপদ সংকুল ছিল যে, ঐ আন্দোলনের অস্তিত্ব দৃঢ়তার সাথে অবিচল রাখা এমনকি আন্দোলনে টিকে থাকাটাই ছিল বিপজ্জনক। তবে আরব আন্দোলনটা ছিল ইসলামের ভিত্তিমূলে সুস্থিত। আন্দোলনকারীগণ একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ বিচিত্র দুর্নীতি ও দুর্বলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তার পাশাপাশি পশ্চিমা আধিপত্যবাদের মোকাবেলায় মুসলিম উম্মাহর শক্তিশালী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দৃঢ় আত্মা ও প্রাণশক্তি অর্জনের লক্ষ্যে দ্বীনের সংস্কারও করেছিলেন।

আরব চিন্তাবিদগণ পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে বিচিত্র চিন্তাদর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই চিন্তাবিদ মনীষীদেরকে কয়েকটি শ্রেণীতে স্তরবিন্যস্ত করা যেতে পারে। একটি স্তরে কিংবা বলা যেতে পারে সবোর্চ্চ স্তরে পড়বে রেফায়া তাহতাভি এবং খায়রুদ্দিন তুনেসির নাম। সাইয়্যেদ জামালুদ্দিন আসাদাবাদী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ উবাদা ছিলেন ইসলামের সুমহান আদর্শপুষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদদের অন্যতম। একইভাবে রাশিদ রেযা, হাসানুল বান্না এবং সাইয়্যেদ কুতুব ছিলেন মৌলিক ইসলামপন্থী আন্দোলন এবং ইসলামী চিন্তাশীলদের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনকারীদের নেতা ছিলেন তাঁরা। সময় এবং যুগের রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী আন্দোলনের এইসব মহান নেতৃবৃন্দ যুগোপযুগি গাইড লাইন দিতেন এবং সে অনুযায়ী তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতেন। তাঁদের চিন্তাধারা সবসময়ই পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বৈশিষ্ট্য লালন করেছে।

ইসলামী গণজাগরণের সর্বপ্রথম জোয়ারটি এসেছিল কনটেমপোরারি অ্যারাবিক থট চিন্তাদর্শের উদ্যোক্তা মিশরীয় ইসলামী চিন্তাবিদ তাহতাভি এবং তিউনিশীয় ইসলামী চিন্তাবিদ খাইরুদ্দিন তিউনেশির মাধ্যমে। তাঁদের চিন্তা ছিল এই যে, ইউরোপীয় জ্ঞান, শিল্প, নাগরিকতা এবং চিন্তাদর্শগুলো চর্চার মধ্য দিয়ে ইসলামী সমাজের মান-মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব হবে। সেজন্যে তাঁদের চিন্তাদর্শের কেন্দ্রমূলে ছিল ইউরোপীয় জ্ঞান অর্জন। এই জ্ঞান অর্জন ব্যতিত মুসলমানদের উন্নতি সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করতেন। তবে তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব। এই সক্ষমতা প্রমাণ করার জণ্যে তিনি মুসলমানদের অতীত ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেনঃ ইউরোপীয় সভ্যতাটা জ্ঞানের ভিত্তিমূল স্থিত এবং এই জ্ঞান তারা মুসলমানদের কাছ থেকেই লাভ করেছে। তবে তাহতাভি মৌলিক যে বিষয়ের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন না তা হলো পাশ্চাত্য এবং উপনিবেশবাদের স্বরূপ অর্থাৎ ইসলামী সমাজের পশ্চাদপদতার মূল কারণ সম্পর্কে। এ ব্যাপারে তাঁর কিছুটা উদাসীনতা বা নিস্পৃহতা ছিল। তবে তাহতাভি যেহেতু আরবদের ব্যাপারে কিংবা বলা যায় মিশরের উন্নয়নের ব্যাপারেই চিন্তাভাবনা করতেন সেজন্যে তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে আরব জাতীয়তাবাদী হিসেবে।

তাহতাভির দৃষ্টিতে পাশ্চাত্য চিন্তাদর্শ আর ইসলামের মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্যরেখা নেই। কেননা ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মই হয়েছে ইসলাম থেকে আর ইউরোপীয় জ্ঞান তো প্রাচীন ইসলামী জ্ঞানেরই ভাষান্তরমাত্র। সুতরাং এই সভ্যতা অর্জনের পথে কোনো বাধা নেই। আরব জাতীয়তাবাদী চিন্তাদর্শের অপর চিন্তাবিদ ছিলেন খায়রুদ্দিন তিউনিশী। তিনি মনে করেন অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের মানোন্নয়নে ইসলামী ফিকাহর সংস্কারে কোনো বাধা নেই। এক হিসেবে তাঁর চিন্তাও তাহতাভির মতোই অনেকটা। তিনিও যখন আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলতেন সেই জাতীয়তাবাদ বলতে পুরো আরবি ভাষী ভূখণ্ডকে বোঝাতো না, বরং মিশরকেই বোঝাতো। যেমনটি তাহতাভিও চিন্তা করতেন।

ইসলামী জাগরণের ধারায় আরব চিন্তাবিদদের আরেকটি দল হলো “ইসলামী সভ্যতাপন্থী”। এই ধারার প্রধান চিন্তাবিদদের অন্যতম হলেন সাইয়্যেদ জামাল উদ্দিন আসাদাবাদী এবং শেখ মুহাম্মাদ আবদুহ। সাইয়্যেদ জামালের সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের অনেকগুলো দিক ছিল। তাঁর সংস্কারের মূল প্রাণটা ছিল আধুনিকতা।

তাঁর প্রশ্ন ছিলঃ ইউরোপ কেন এতো উন্নতি করলো আর মুসলমানরা কেন এতো পিছিয়ে পড়লো? তিনি সবসময় চেয়েছেন আধুনিক এই যুগে আধুনিকতার উন্নয়নের ধারায় মুসলমানদেরও সম্পৃক্ত হবার পরিবেশ সৃষ্টি করতে। সেই লক্ষ্যে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য ও উপাদানগুলোর সাথে মুসলমানদেরকে পরিচয় করাতে চেয়েছেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন মুসলমানরা জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মতো মূল উপাদানগুলোর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অগ্রসর হতে পারে। তিনি চেয়েছেন মুসলিম বিশ্বের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে এবং তাদের প্রকৃত স্বরূপ ফিরিয়ে আনতে। তাদের হারানো শক্তি ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে তিনি পশ্চিমাদের জ্ঞান চর্চাকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতেন। জামালুদ্দিন ছিলেন অনেকটা বিপ্লবী আর আবদুহ ছিলেন সংস্কারকামী। তবে দুজনই চেয়েছিলেন ইসলামী জাগরণ।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৩০

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন