সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮ ১৮:৫৮ Asia/Dhaka
  • ধরণীর বেহেশত মসজিদ: প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদ

আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের সাপ্তাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান- ধরণীর বেহেশত মসজিদে। আশা করছি সবাই ভালো আছেন। আজকের আসরে আমরা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। সেইসঙ্গে থাকবে ফ্রান্সের আরো দু’টি মসজিদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

মসজিদের সূচনালগ্ন থেকে আল্লাহর এই ঘর নামাজ আদায়ের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি মুসলমানদের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া আদেশ-নিষেধগুলো মসজিদে বসে জনগণের সামনে তুলে ধরতেন। সেইসঙ্গে সামাজিক তৎপরতা, শাসনকাজ পরিচালনা, যুদ্ধনীতি ও কৌশল নিয়ে এই মসজিদে বসেই শলাপরামর্শ করতেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে মসজিদ ছিল মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বিচারবিভাগীয় এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু।

বর্তমান যুগেও নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মসজিদ মুসলমানদের সর্বোত্তম জমায়েতস্থল হিসেবে বিবেচিত। মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য মসজিদের মতো উত্তম স্থান আর হতে পারে না। এ কারণে আরব উপত্যকা থেকে বিশ্বের যে প্রান্তেই ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে সে প্রান্তেই নির্মিত হয়েছে অসংখ্য মসজিদ। বিগত কয়েক দশকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে অগণিত অমুসলমান শান্তির ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তারা এসব দেশে নির্মাণ করেছেন অসংখ্য সুন্দর সুন্দর মসজিদ। ইউরোপে মসজিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতাও বেড়েছে। কোনো কেনো দেশে নতুন করে মসজিদ স্থাপনের বিরোধিতা করা হচ্ছে। অথচ ইউরোপীয়রাই ধর্মীয় ও বাক স্বাধীনতার যে কথা বলে তার সঙ্গে এই বিরোধিতা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের মসজিদ

আসরের এ পর্যায়ে আমরা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। এটি ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় এবং ইউরোপ মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে যেসব মুসলমান নিহত হয়েছেন তাদের স্মরণে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলমানরা ১৮৯৫ সালে প্রথম প্যারিস শহরে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সে পরিকল্পনা তখন আলোর মুখ দেখেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মরক্কোর বংশোদ্ভূত একজন মুসলিম নেতা ফ্রান্স সরকারের কাছে এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা পেশ করেন। ফ্রান্সের আঞ্জুমানে ওকাফের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী ওই মুসলিম নেতার নাম ছিল সাইয়্যেদ কাদ্দুর বিন কিবরিয়াত। তিনি যখন এ প্রস্তাব তুলে ধরেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে নিহত মুসলমানদের স্মরণে কিছু একটা করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি মুসলিম সমাজকে খুশি করতে চাচ্ছিল ফরাসি সরকার।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদ

মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবে প্যারিস সরকারের সে কাজটি অনেকটা সহজ হয়ে যায়। ১৯২২ সালে ফ্রান্সের পার্লামেন্টে এই মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব পাস হয় এবং এই কাজে পাঁচ লাখ ফ্রাঙ্ক অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। প্যারিস সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মসজিদ নির্মাণের জন্য নগরীর সবচেয়ে দামী এলাকায় ৭,৫০০ বর্গমিটার জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। মসজিদ নির্মাণের কাজে ফ্রান্স সরকারের পাশাপাশি ফরাসি উপনিবেশভুক্ত দেশ আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কোর মতো দেশগুলোর মুসলমানরাও আর্থিক অনুদান দেন।  ১৯২৬ সালের ১৫ জুলাই ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্যাস্তোন দুমার্গ প্যারিস গ্র্যান্ড মসজিদ উদ্বোধন করেন। ওইদিনই এই মসজিদে প্রথম নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। ওই নামাজের ইমামতি করেছিলেন ফ্রান্সের বিশিষ্ট আলেম আহমাদ আল-আলাভি। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এই মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ফরাসি নাগরিকরা। ওই বছর হামজা আবুবকর নামের আলজেরিয় বংশোদ্ভূত একজন মুসলমানকে এই মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান করা হয়। তিনি অবসরে যাওয়ার সময় মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব আলজেরিয়া সরকারের কাছে ন্যস্ত করেন।  বিষয়টি ফরাসি নাগরিকরা তাদের দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করেন এবং তাদের প্রতিবাদের মুখে ১৯৯২ সালে একজন ফরাসি নাগরিককে মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান নিযুক্ত করা হয়।

 প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদ

বর্তমানে প্যারিস গ্র্যান্ড মসজিদে স্থাপিত একটি ইসলামি সংস্থা  ফ্রান্সের সব মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এই সংস্থা দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার জন্য ‘গাজ্জালি সেন্টার’ নামক একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করে। ফ্রান্সের সব মসজিদের ইমামরা এই মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম। মুসলমানদের বেশিরভাগ সামাজিক কাজের সঙ্গে প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদ জড়িত। বিবাহ ও তালাক, আইনি পরামর্শ, সারাদেশের জুমা ও ঈদের নামাজ পরিচালনা, হজ্বে লোক পাঠানো, হালাল উপায়ে পশু জবাই করার ওপর নজরদারি, মৃত ব্যক্তিদের দাফন, এতিম শিশু ও অসহায় পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদানসহ এ ধরনের আরো অনেক সেবামূলক কাজ করে এই মসজিদ। মসজিদের ইসলামি সংস্থার উদ্যোগে এখানে স্থাপিত হয়েছে একটি বিশাল লাইব্রেরি। সেইসঙ্গে ইসলামকে অমুসলিমদের সামনে তুলে ধরার জন্য মসজিদের অডিটোরিয়ামে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া, মুসলিমদের জন্য এখানে অনুষ্ঠিত হয় তাফসিরে কুরআন মাহফিল এবং হাদিস ও ফিকাহ শিক্ষার ক্লাস।

প্যারিস জামে মসজিদের প্রধান হলরুমের পাশাপাশি রয়েছে দু’টি বিশাল বারান্দা এবং একটি সুউচ্চ মিনার। মসজিদের স্তম্ভগুলো তৈরি হয়েছে মরমর পাথর দিয়ে। কোনো কোনো স্থানে দু’টি বা তিনটি ছোট স্তম্ভ একটি বড় পিলারের উপর স্থাপন করা হয়েছে। প্যারিস গ্র্যান্ড মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল উন্মুক্ত স্থান। ঈদের নামাজগুলোসহ বিশেষ বিশেষ দিনে মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হলে এই আঙিনায় নামাজে দাঁড়ান মুসল্লিরা। এই আঙনার চারদিকে রয়েছে উঁচু দেয়াল। মসজিদের দেয়ালের মতো টাইলসের ওপর সুন্দর কারুকাজ দিয়ে এই দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। প্যারিস গ্র্যান্ড মসজিদ সংলগ্ন বাজারে রয়েছে রেস্টুরেন্ট ও কফিশপ। এই রেস্টুরেন্টে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করা হয়।

প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদের লাইব্রেরি

এখানে একটি কথা না বললেই নয় আর তা হলো ইউরোপের যেসব দেশের সরকার সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে ফ্রান্স তাদের অন্যতম। ইসলাম আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্যারিস ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশ্বনবী (সা.)’র অবমাননা করে কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলাম বিদ্বেষী এতসব তৎপরতার পরও ফ্রান্সে গির্জার চেয়ে মসজিদের সংখ্যা বেশি। প্যারিসের ক্রিটেইল এলাকায় অবস্থিত আরেকটি মসজিদের নাম সাহাবা মসজিদ।  প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই মসজিদে বছরে গড়ে প্রায় দেড় লাখ ফরাসি নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করেন বলে এই মসজিদকে ‘ইসলাম গ্রহণকারীদের মসজিদ’ নামেও অভিহিত করা হয়।

ফ্রান্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মসজিদের নাম জিভোর মসজিদ। এই মসজিদটি ফ্রান্সের শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই মরক্কোর একজন শিয়া মুসলমানের উদ্যোগে সাউথ লিওন এলাকায় এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবে প্রভাবিত হয়ে মরক্কোর বংশোদ্ভূত একদল তরুণ শিয়া মাজহাব গ্রহণ করেন এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্মিত মসজিদটিকে তারা শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করেন। শিয়া ও সুন্নি দুই মাজহাবের মুসলমানরাই এখানে নামাজ আদায় করেন। এই মসজিদে প্রতি বছর রমজান মাসে সুন্নি মুসলমানরা তারাবি’র নামাজ আদায় করেন এবং শিয়া মুসলমানরা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটান। জিভোর মসজিদটি সত্যিকার অর্থেই শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ২৬

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিনhttps://www.facebook.com/parstodaybn/

ট্যাগ