অক্টোবর ০৬, ২০১৮ ২০:৫৬ Asia/Dhaka

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান- ঐশী দিশারীতে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার জীবনী সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করেছি।

আজকের আসরেও আমরা এই মহীয়সী নারীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।

আল্লাহ তায়ালা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘর আলো করে চারজন নেক সন্তান দান করেন। তারা হলেন হাসান, হোসেইন, জয়নাব ও উম্মে কুলসুম। এই চার সন্তান ছিলেন তাদের পিতা-মাতার মতো পবিত্র ও মহান চরিত্রের অধিকারী। মুসলিম সমাজের জন্য আদর্শস্থানীয় এই চার সন্তানকে উপযুক্ত করে প্রতিপালনের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন হযরত জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহা। হযরত ফাতিমা তাঁর সন্তানদের এমনভাবে প্রতিপালন করেন যে, এসব সন্তান ইসলামের অনেক কঠিন সময় ও ক্রান্তিকালে দ্বীন রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেইন (আ.) ইমামতের উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে মুসলিম সমাজকে নেতৃত্ব দেন।

হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার বংশধরদের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তারা নিষ্পাপ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া তাঁরা কোনো কাজ করেননি। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত ফাতিমাকে উদ্দেশ করে বলেছেন: মহান আল্লাহ আমাকে পৃথিবীর সব মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আমার পরে তোমার স্বামী আলীকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এরপর তোমাকে করেছেন বিশ্বের নারীকুলের শিরোমণী এবং তোমার দুই সন্তান হাসান ও হোসেইনকে করেছেন জান্নাতের যুবকদের সর্দার।

একটি সংসারের স্বামী ও স্ত্রীকে যেসব গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয় তার মধ্যে ঘরের মধ্যে ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি অন্যতম। সন্তানদের উপযুক্ত খাবার ও পুষ্টির ব্যবস্থা করে তাদের শারিরীক বৃদ্ধির দিকে যেমন মনযোগ দিতে হবে তেমনি তাদের আত্মিক চাহিদা পূরণ করে উন্নত মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটানোও পিতামাতার কর্তব্য। শিশুদের যেসব মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে শেখানো।  এ কারণে হযরত জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহা সবার আগে সন্তানদেরকে নামাজ শিক্ষা দেন। আল্লাহর ইবাদতের দিক থেকে আল্লাহর রাসূল এবং হযরত আলী (আ.)-এর পরেই ছিল তাঁর অবস্থান। বিশ্বনবী (সা.) এ সম্পর্কে বলেন: আমার মেয়ে ফাতিমা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। সে আমার কলিজার টুকরা এবং আমার অন্তর জুড়ে তার অবস্থান। সে যেন মানব শরীরে অবস্থান নেয়া বেহেশতের হুর। সে যখন আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ায় তখন তাঁর নূরের আলো আসমানের ফেরেশতাদের আলোকিত করে তোলে।

মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলামে বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের ওপর যেমন জোর তাকিদ দেয়া হয়েছে তেমনি আল্লাহর বান্দাদের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে। ঠিক এ কারণেই পবিত্র কুরআনে নামাজের পরই যাকাতের কথা এসেছে এবং কখনো নামাজ এবং দান-খয়রাত করাকে পাশাপাশি স্থান দেয়া হয়েছে। হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার জীবন অনেক সাধাসিধে হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের এই নির্দেশ পালনে তাঁর কোনো তুলনা ছিল না।  নিজের জীবনে অর্থনৈতিক দৈন্য থাকা সত্ত্বেও তিনি অভাবী ও ক্ষুধার্ত লোকের কথা ভুলে যাননি।

জাবের আব্দুল্লাহ আনসারি এ সম্পর্কে বলেন, একদিন আসরের নামাজের পর জীর্ণবস্ত্র পরিহিত এক বৃদ্ধ মসজিদে প্রবেশ করে। রাসূল্লাহ (সা.) তার কাছে কুশল জিজ্ঞাসা করলে সে বলে- আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে কিছু খাবার দিন। আমার কিছু টাকা-পয়সা এবং ভালো কাপড়ও দরকার। আল্লাহর রাসূল বৃদ্ধ ব্যক্তিকে হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য হযরত বেলালকে নির্দেশ দেন। বৃদ্ধ লোকটি রাসূলের কন্যার কাছে গিয়ে তার সব অভাবের কথা খুলে বলেন।  হযরত জাহরা তার চাচাতো বোনের দেয়া উপহার নিজের গলার হারখানা খুলে ওই দরিদ্র ব্যক্তিকে দিয়ে বলেন: এটি বিক্রি করে আপনি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে নিন। 

 

আম্মার একথা শুনে বৃদ্ধের কাছ থেকে হারখানা কিনে নিয়ে তার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। এরপর বৃদ্ধ ব্যক্তি রাসূলের কাছে ফিরে আসেন।  বিশ্বনবী তাকে জিজ্ঞাসা করেন তার প্রয়োজনগুলো মিটেছে কিনা। সে উত্তর দেয়: আপনার কন্যার দয়ার দানে আমার এখন আর অভাব নেই। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছি তিনি যেন ফাতিমাকে এমন কিছু দান করেন যা কেউ কোনোদিন চোখে দেখেনি এবং কানেও শোনেনি। বৃদ্ধের এ কথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীতেই ফাতিমাকে এমন জিনিস দান করেছেন।  ফাতিমাকে আল্লাহ আমার মতো পিতা দিয়েছেন, আলীর মতো স্বামী দিয়েছেন এবং হাসান ও হোসেইনের মতো সন্তান দান করেছেন।

 

 

ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা, তাঁর স্বামী এবং সন্তানেরা নিজেদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিনগুলিতেও পরের উপকার করার কথা ভুলে যাননি। ইবনে আব্বাস এ সম্পর্কে বলেন: একবার হাসান ও হোসেইন (আ.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। আল্লাহর রাসূল তাদেরকে দেখতে গিয়ে আলী (আ.)কে বলেন: সন্তানদের সুস্থতার জন্য কিছু একটা মানত করো। এ সময় হযরত ফাতিমা, আলী, হাসান ও হোসেইন চারজনই সুস্থতা লাভের জন্য নফল রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। হযরত হাসান ও হোসেইন (আ.) সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁরা সবাই মিলে রোজা রাখেন। হযরত জাহরা ইফতারির জন্য কয়েকটা রুটি তৈরি করেন। ইফতারের আগ মুহূর্তে এক ভিক্ষুক এসে নিজেকে ক্ষুধার্ত বলে পরিচয় দিয়ে কিছু খেতে চায়। রাসূলের কন্যা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ভিক্ষুককে সবগুলো রুটি দিয়ে দেন। এরপর নিজেরা শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেন। পরদিন তাঁরা আবার রোজা রাখেন এবং ইফতারির জন্য কয়েকটি রুটি তৈরি করেন। এদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে একজন এতিম এসে খাবার চাইলে আবার তারা সবগুলো রুটি এতিমকে দান করে নিজেরা শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেন।

এভাবে তৃতীয় দিন একজন বন্দি এসে খাবার চাইলে টানা তিনদিন ধরে অভুক্ষ নবী পরিবারের চার সদস্য তাদের ইফতারির জন্য তৈরি সবগুলো রুটি তাকে দিয়ে নিজেরা শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেন। তৃতীয় দিনের ইফতারির পরপরই হযরত জিব্রাইল সূরা ইনসান বা আদ-দাহরের প্রথম কয়েকটি আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা আপনার সন্তানদের এ দানে সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং এজন্য আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।  এই সূরার ৭ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে অভুক্ত অবস্থায় আহলে বাইতের চার সদস্যের আত্মোৎসর্গের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: “তারা মান্নত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে,যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী।”   “তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত,এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।” “তারা বলেঃ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।”#

 

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ৬

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন