অক্টোবর ২৯, ২০১৮ ২০:২৫ Asia/Dhaka

এক বুড়ি থাকত পাহাড়ের কাছে এক বাড়িতে। বুড়ি একাই থাকত সেখানে। পাহাড়ের ওপরে ছিল এক বাঘ। বাঘটি প্রায়ই নিচে নেমে বুড়ির মুলা ক্ষেতে ঢুকত আর টেনে-টুনে মুলা নষ্ট করত। বাঘটা যদি খাবারের জন্যে এই কাণ্ড করত তাহলে বুড়ির হয়তো কিছুই বলার থাকত না কিন্তু তা তো নয়। বাঘ এমনটা কেবল মজা করবার জন্যে। বুড়ির তাই ভারি রাগ হত।

একদিন বাঘ যখন ক্ষেত তছনছ করছে তখন বুড়ির সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। এ সময় বাঘকে জব্দ করার জন্য বুড়ির মাথায় সুন্দর একটা বুদ্ধি চলে এলো। বুড়ি মিষ্টি করে বাঘকে বলল, ও বাঘ, এই পানসে মুলা খাও কেন? আজ রাতের বেলায় আমার বাড়িতে এসো, আমি তোমাকে চাল আর লাল মটরশুঁটি দিয়ে মজাদার পায়েস রেঁধে খাওয়াব।

দাওয়াত পেয়ে বাঘ বেজায় খুশি হল। রাতে অবশ্যই আসবে এই কথা দিয়ে সে পাহাড়ে ফিরে গেল। বাঘ চলে যাওয়ার পর বুড়ি বাড়িতে ফিরে গেল। সে পায়েস-টায়েস কিছুই রাঁধল না। তার বদলে প্রথমে একটা কাঠ কয়লার চুলা ধরিয়ে পেছনের আঙিনায় রেখ আসল। এরপর হেঁসেলের কলসিতে পানি ভরে তাতে অনেকখানি মরিচের গুঁড়ো ছেড়ে দিল। আর একটা গামছায় অনেকগুলো সূঁচ বিধিয়ে সেটা কলসির ওপর আটকে রাখল। সবশেষে হেঁসেলে মেঝের সামনের দিকটায় গোবর ছড়িয়ে, তার ওপর দরজার দিকে মাথা করে একটা মাদুর পাতল। আর একজন মুটেকে বাইরের বেড়ার কাছে ওঁৎ পেতে থাকতে বলল। এসব করে-টরে বুড়ি ঘরে গিয়ে বাঘের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

এরপর যখন রাতে আঁধার নেমে এল তখন বাঘ এসে হাজির হল। বুড়ি ভাবখানা এমন দেখায় যে, বাঘ আসার সে ভীষণ খুশি হয়েছে। একটুখানি হেসে বুড়ি বলল : "শুভ রাত্রি, তুমি কষ্ট করে এসেছ দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। ভেতরে আসার আগে পেছনের আঙিনা থেকে আমার চুলাটা এনে দাওনা! ঘরে আমার ভীষণ শীত লাগছে।"

বাঘ গেল পেছনের আঙিনা। গিয়ে দেখল, কয়লার আগুন নিভু নিভু। এ অবস্থা দেখে বাঘ বলল : নানী ও নানী, আগুন তো নিভে যাচ্ছে।

বুড়ি বলল: তাই নাকি? তাহলে ছাইতে ফুঁ দাও। তাতে আগুন আবারো জ্বলে উঠবে।

বাঘ ফুঁ দিতে লাগল। মুহূর্তেই ছাই উড়ে এসে সোজা তার চোখে গিয়ে ঢুকল। বাঘ চিৎকার করে বলে উঠল: হায়, হায়, আমার চোখ গেল, চোখ গেল।

এরপর জ্বালা থামানোর জন্য বাঘ চোখ রগড়াতে লাগল। কিন্তু যত জোরে রগড়ায় জ্বালা ততই বাড়তে থাকল। শেষে কিছুই বুঝতে না পেরে সে চেঁচিয়ে বলল : নানী, চোখে ছাই পড়ছে বড্ড জ্বালা করছে। এখন আমার উপায় কি তাই বল।

বুড়ি বলল: আহা বাছা, এত কান্নাকাটি করছ কেন-হেঁসেলে কলসিতে পানি আছে। পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেল সব ঠিক হয়ে যাবে।

বুড়ি কথায় বাঘ দৌড়ে গেল হেঁসেলের কাছে। তারপর কলসির পানি দিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ ধুয়ে ফেলল। বন্ধুরা, তোমরা জানোই তো, বুড়ি কলসির পানিতে মরিচের গুঁড়া গুলে রেখেছিল। ফলে ওই পানি চোখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের জ্বালা ভয়ানক বেড়ে গেল। সেই জ্বালায় বাঘ তখন পাগলের মত চিৎকার করে বলে উঠল: হায় হায়, আমার চোখ গেল নানী, চোখ গেল। জ্বালা যে আরো বেড়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করো

বুড়ি বলল : আহা বাছা এত অস্থির হয়োনা! কলসির ওপরে ঝুলিয়ে রাখা গামছাটা নিয়ে চোখ মুছে ফেল।

বাঘ তখন প্রায় অন্ধ। সে হাতড়ে হাতড়ে গামছা নিয়ে জোরে জোরে চোখ মুছতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে গামছার সুঁচগুলো তার চোখে বিধে গেল। বাঘ তখন অসহায়ের মতো লাফ-ঝাঁপ দিতে লাগল। তার আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, বুড়ি তাকে ফাঁদে ফেলেছে। তাই সে পালানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু যেই হেঁসেল থেকে বাইরে দৌড় দিল অমনি পা পিছলে গোবরে ওপর পড়ে গেল। এদিকে মেঝেয় পা পড়তেই মাদুরটা তার পায়ে জড়িয়ে গেল। সে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়ল মুটের দিকে। অমনি মুটে তাকে বস্তায় পুরে গট-গট করে নদীর দিকে রওনা হল। সেখানে পৌঁছেই তাকে নদীতে ফেলে দিল। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর বাঘ সাঁতরে ডাঙায় উঠল। কিন্তু তাতে কি? সে আর জীবনেও বুড়ির মুলাক্ষেতে যাওয়ার চিন্তা করল না।

বাঘ, কচ্ছপ ও শেয়াল

এক বনে এক খরগোশের বিয়ে। বিয়েতে দাওয়াত পেল বনের অন্য প্রাণীরা। উপস্থিত হলো বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, হনুমান, কাক, কোকিল, বক, চিল, দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়া, বাদুড়, হাতি, ঘোড়া, মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল, আঞ্জন, গয়াল ও বনের সবচেয়ে উঁচু প্রাণী জিরাফ।

বিয়েতে সবার সঙ্গে সবার দেখা হলো। হলো ভাব বিনিময়। সিংহের সামনে বাঘ, বাঘের সামনে হরিণ। হরিণের দল আনন্দে লাফালাফি করছে। বাঘ বাঁকা চোখে এসব দেখে। কিন্তু ঘাড় মটকাতে পারে না। রক্ত খেতে পারে না।

বনের গরু সদলবলে বাঘের সামনে হাঁটছে। ভেড়া দলবেঁধে ছোটাছুটি করছে। পাখিরা মনের আনন্দে উড়াউড়ি ঘুরাঘুরি করছে। কেউ কাউকে আক্রমণ করছে না। কারণ, মাস কয়েক আগে বনে নতুন নিয়ম করা হয়েছে। কারো বিয়ে, জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনের অনুষ্ঠানে বড়রা ছোটদের মারবে না। এমনকি কেউ কারো ঘাড়ও মটকাতে পারবে না। নিয়মের বাইরে গেলে বনের রাজা বিচার করবেন। বিচার অনুয়ায়ী অপরাধীকে সাজা ভোগ করতে হবে।

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে যে যার মতো বাড়ি ফিরছিল। গল্প করতে করতে একসঙ্গে ফিরছে শেয়াল আর কচ্ছপ। দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর দুজনেই ক্লান্ত। একটু দূরে আড়ালে গিয়ে বসল তারা। এরপর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া শুরু করল। আড্ডায় অনেক আলাপ আলোচনা হয় বনের প্রাণীদের সুখ-দুঃখ নিয়ে। দুর্বলের উপর সবলের আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। কেউ কারো উপর অত্যাচার করতে পারবে না এমন আইন করতে হবে।

শেয়াল আর কচ্ছপের বন্ধুত্বের কথা বনের সবাই জানে। জানে বলেই বনের পশু-পাখিরা তাদের হিংসা করে। শেয়াল সেদিকে কান দিতে চায় না। চারপাশের কানাঘুষা চলে। কচ্ছপের মনে ভয় বাড়ে, যদি বন্ধুত্ব ভেঙে যায়, ভুল বুঝে শেয়াল দূরে সরে যায়!

শেয়াল কোনো গুজবেই কান দিতে চায় না। নিজেরা ঠিক থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হবে না। শেয়াল বিশ্বাস করে, বনে এমন বন্ধুত্ব আরো থাকা দরকার। তাহলে সবার মাঝে শান্তি ফিরবে। কারণে-অকারণে কেউ কাউকে মারবে না। দুর্বলের উপর ঝাপিয়ে পড়বে না। সবার মাঝে ফিরে আসবে শান্তি-শৃঙ্খলা।

শেয়াল আর কচ্ছপ গভীর আলোচনায় মগ্ন। দূর থেকে দেখছে এক বাঘ। বাঘ খুবই ক্ষুধার্ত। সারাদিন কিছু খেতে পায় না। বাঘ ভাবছে এবার অন্তত ক্ষুধা মিটবে। বাঘ নিঃশব্দে এগিয়ে আসে সামনের দিকে। তা দেখতে পায় শেয়াল। এমন বিপদের কথা কচ্ছপকে না জানিয়ে কেটে পড়ে, দূরে গিয়ে সামান্য আড়ালে বসে থাকে। আর মুখ বের করে বাঘের তামাশা দেখে। আপাতত শেয়াল বাঘের নাগাল থেকে দূরে, নিরাপদ জায়গায়।

কচ্ছপ ধীর পায়ে হাঁটছে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেনি। বাঘ দৌড়ে ধরে ফেলে। আজ কচ্ছপ খেয়েই ক্ষুধা মিটাবে সে। কচ্ছপের মাংস খেতে বেশ মজা। কিন্তু খেতে গিয়ে কোনভাবেই সুবিধা করতে পারল না বাঘ। কচ্ছপের শরীরের উপরের অংশ যে খুব শক্ত! বুড়ো বাঘের দাঁতে কুলোয় না। একবার মুখে নেয় আরেকবার বের করে। কচ্ছপের চোখজোড়া কোটরের ভেতর। মাঝে মধ্যে চোখ খোলে। মিটমিট করে দেখে। দেখতে দেখতে ভয় পায়, ভয়ে আরো জড়ো হয়ে আসে, ভেতরের দিকে যায়। বন্ধুকে খোঁজে। বিপদের দিনে বন্ধুর সহযোগিতা দরকার। বুদ্ধিমান শেয়ালের সহযোগিতা দরকার, অথচ সে আগেই পালিয়েছে।

এদিকে, বাঘ চেষ্টা করে যাচ্ছে যেভাবেই হোক কচ্ছপের মাংস খাবেই, খাবে। কষ্ট হলেও খাবে। চাইলেইতো আর যখন-তখন কচ্ছপ মেলে না! কচ্ছপের মাংস খেতে হলে ভাগ্য লাগে। এই মাংসে শক্তি দুই-তিন গুণ বাড়ে। এমন সুযোগ কোন আহাম্মক হাতছাড়া করবে? অন্তত বাঘ হাতছাড়া করতে চায় না। বাঘের মেজাজ খুব খারাপ। সহযোগিতার জন্য এদিক-সেদিক তাকায়। আশপাশে কেউ নেই।

এমন সময় বাঘের কানে ভেসে এলো ‘মামা’ শব্দটি। বাঘ এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। এরপর আবারও সেই 'মামা' ডাকটি শুনতে পেয়ে বাঘের নজর গেল আড়ালে থাকা শেয়ালের দিকে। এসময় বাঘ বলল:

বাঘ: ভাগিনা, তুমি ওখানে কেন?

শেয়াল: মামা যেখানে ভাগিনাও সেখানে।

বাঘ: হুম। মামা-ভাগিনা যেখানে বিপদ নাই সেখানে।

শেয়াল: মামা, তুমি এখানে কী করছ?

বাঘ: ভাগিনা, কয়দিন ধরে খুবই ক্ষুধার্ত। সামনেই কচ্ছপটি পেয়ে গেলাম। তাছাড়া কচ্ছপের মাংসে খুবই শক্তি। খেতেও মজা। অল্পতেই ক্ষুধা মিটে। ভাগিনা, চাইলে তুমিও আসতে পারো।

শেয়াল: আমি এলে তোমার ভাগে যে কম পড়বে।

বাঘ: তুমি তো ছোট। পরিমাণে কম খাবে।

শেয়াল: মামা, আগে বলো, এটা খাবো কীভাবে?

বাঘ: চেষ্টা করে দেখি, উপায় একটা বের হবে।

শেয়াল: কষ্ট করার দরকার নেই। এটা খাওয়ার উপায় আমার জানা আছে।

বাঘ: ভাগিনা, জলদি বলো। ক্ষুধায় দুর্বল আমি। কোনো বুদ্ধি মাথায় কাজ করছে না।

শেয়াল: তুমি যে বোকা তা বনের সবাই জানে।

বাঘ: ভাগিনা, তুমিও বোকা বললে? খুব কষ্ট পেয়েছি। মামাকে কেউ বদনাম দিলে তোমার উচিত প্রতিবাদ করা।

শেয়াল: ওরা সংখ্যায় বেশি ছিল। তাই পারিনি।

বাঘ: ওসব পরে হবে। আগে বলো কীভাবে কচ্ছপ খাবো।

শেয়াল: মামা, কচ্ছপটি আগুনে ফেলো। তখন পুড়ে নরম হবে, খেতে কষ্ট হবে না। তাছাড়া পোড়া মাংসের মজাই অন্যরকম।

শেয়ালের পরামর্শ শুনে কচ্ছপের জিহ্বা শুকিয়ে আসে। চোখ লাল হয়। পানি জমে। শরীরের অর্ধেক শক্তি কমে আসে। কচ্ছপ ভাবে,  শেয়াল আমার বন্ধু! বন্ধু হয়ে সর্বনাশী বুদ্ধি দিতে পারল! বাস্তবে শেয়াল কারো বন্ধু হয় না। হতে পারে না। বুঝলাম, শেয়াল যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন হবে না। এরা আজীবন ধূর্ত থাকে। হতে পারে শেয়ালই বাঘ ডেকে এনেছে। এতদিন সে আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করেছে। আসলে বিপদের দিনে বন্ধু চেনা যায়।

কচ্ছপ যখন এসব ভাবছিল তখন বাঘ শেয়ালকে বলল:

বাঘ: আচ্ছা ভাগিনা, বনে আগুন পাবো কোথায়?

শেয়াল: তাই তো... তাই তো! আরেকটি বুদ্ধি বের করি তাহলে?

বাঘ: খুবই ক্ষুধা পেয়েছে। তাড়াতাড়ি বুদ্ধি বের করো। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।

শেয়াল: মামা, একে নদীতে ফেলে দাও। ভিজে নরম হবে। তখন খেতে ভালো লাগবে।

বাঘ: তোমার বুদ্ধির জবাব নেই। এই বনে তুমিই আমার একমাত্র ভাগিনা। বাকিরা শত্রু। না হয় এত ভালো বুদ্ধি কেউ দিলো না কেন! উল্টো সবাই পালিয়েছে।

এরপর বাঘ নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে-ডানে-বামে একবার করে তাকাল। তাকানোর পর কচ্ছপটি নদীতে ছুঁড়ে মারল। কচ্ছপ মুহূর্তেই তলিয়ে গেল। পাড়ে অপেক্ষা করতে লাগল বাঘ। কচ্ছপ ভিজে নরম হয়ে এলেই খাবে এবং ক্ষুধা মিটাবে। বাঘের অপেক্ষা শুরু হয়। কচ্ছপ আর ফিরে আসে না।

চারপাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সূর্যও ডুবে যাচ্ছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। বাঘ বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত। রাগে-ক্ষোভে ফিরে এলো শেয়ালের কাছে। এসে দেখে সেখানে শেয়াল নেই। বাঘের বুঝতে আর বাকি রইল না। মনে পড়ল শেয়াল আর কচ্ছপের বন্ধুত্বের কথা। বোকা বাঘ মনের দুঃখে আবার বনের দিকে হাঁটতে শুরু করে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/মো.আবুসাঈদ/ ২৯

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন